টেলি অভিনেত্রী সুচন্দ্রা দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।
শনিবার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি পুণেতে ছিলাম। ওখানে ওয়াইফাইটা কাজ করছিল না। মোবাইল ডেটাও কাজ করছিল না। রবিবার মুম্বইতে ফিরেই ঝিনুকের (সুচন্দ্রার ডাকনাম) মৃত্যুসংবাদ জানতে পারি। পর পর মেসেজ আসছে। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে, ঝিনুক আর আমাদের মধ্যে নেই। আসলে আমরা একসঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। তা-ও আবার বিদেশে। প্রচুর স্মৃতি। এখন সেগুলোই মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসছে।
একটু পিছিয়ে যাই। ২০১৭ সালে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে ঝিনুককে আমি প্রথম দেখি। আলাপ হয়নি, কিন্তু একঝলক দেখেই পছন্দ হয়েছিল। অত মিষ্টি দেখতে, একগাল হাসি। যাই হোক ভাগ্যের লিখন ছিল অন্য রকম। ২০২০ সালের শুরুর দিক। ভারতে করোনার প্রকোপ বেড়েছে। আমার স্বামী আইটি কোম্পানিতে কর্মরত। চাকরিসূত্রেই আমাদের নেদারল্যান্ডসে চলে যেতে হল। তখনও ওখানে করোনার প্রকোপ সেই ভাবে বাড়েনি। নেদ্যারল্যান্ডস এবং বেলজিয়াম সীমান্তে একটি ছোট্ট শহরে নতুন করে সংসার পাতলাম। কী অদ্ভুত ব্যাপার, ওখানে ভারতীয়দের একটা পার্টিতে ঝিনুকের সঙ্গে আমার দেখা, আলাপ। জানতে পারলাম আমাদের দু’জনের স্বামীই একই কোম্পানিতে কর্মরত। পরে জানতে পারলাম যে ও টুকটাক অভিনয় করেছে। মডেলিংও করেছে। দেখতে একদম পুতুলের মতো। আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
আমার থেকে প্রায় বছর দশেকের ছোট ছিল ঝিনুক। আমাকে অদিতিদি বলে ডাকত। সময়ের সঙ্গে বুঝতে পারলাম মানুষ হিসেবে ঝিনুক অতুলনীয়। কেউ এতটুকু সাহায্য চাইলেই ঝিনুক ছুটে আসত। একটা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই। আমাদের গ্রুপেই এক জন ভদ্রলোকের স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। ওদের প্রথম সন্তানের বয়স তখন ৩ বছর। করোনার প্রকোপে ভদ্রমহিলা ডাক্তার দেখাতে গেলে বাচ্চাটির দেখভাল করত ঝিনুক। এটা কিন্তু শুধু এক দিন নয়, দিনের পর দিন বাচ্চাটিকে নিজের বাড়িতে রেখে দেখভাল করেছিল ঝিনুক। কিন্তু এটা নিয়ে ওকে কোনও দিন বড়াই করতে দেখিনি। আমারও যমজ সন্তান রয়েছে। দুই ছেলেকে সব সময়ে নিজের কাছে ডেকে নিত। ওদের সঙ্গে খেলাধুলো করা, সময় কাটানো... এই ঘটনাগুলো মনে পড়ছে আর ওর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
নেদ্যারল্যান্ডসে আমরা যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম তার নীচে থাকত একটা বাঙালি পরিবার। ওরা বাড়িটা ছাড়তেই আমি ঝিনুককে চলে আসতে বললাম। কারণ সেই সময় ঝিনুকরাও একটা নতুন বাড়ির সন্ধানে ছিল। আমি বলতেই ও এককথায় রাজি হয়ে গেল। আমরা থাকতাম তিন তলায়। ওরা চলে এল নীচের তলায়। তার পর আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সখ্য আরও বেড়েছিল।
নেদ্যারল্যান্ডসে ঘরোয়া আড্ডায় অদিতির সঙ্গে সুচন্দ্রা। ছবি: সংগৃহীত।
বিদেশে নিজের ভাষার মানুষ পাওয়া কঠিন। সেখানে ও হয়ে উঠেছিল আমার ছোট বোনের মতো। একসঙ্গে বাজারহাট করতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া— কত স্মৃতি মনে পড়ছে। শুক্রবারে ওখানে একটা বাজার বসত। সকালে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিতাম যে, কখন বেরোব বা কী কী জিনিসপত্র কিনব। ঝিনুক বরাবরই নিজেকে খুব পরিপাটি রাখতে ভালবাসত। সাজতে খুব পছন্দ করত। অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল বলে, কী ভাবে ছবি তুললে নিজের ছবিটা ভাল আসবে সেটাও ও খুব ভাল জানত। একটা মজার কথা বলি, ওর ছিল একমাথা চুল। ডাচরা দেখে অবাক হয়ে যেত যে ভারতীয়দের মধ্যেও এমন মেয়ে হয়! ওখানকার মহিলারা ওর ওই ঘন কালো মাথাভরা লম্বা চুলের খুব প্রশংসা করত। এক বার তো কয়েক জন ভাবলেন ঝিনুক মাথায় পরচুলা পরে! তার পর সত্যিটা জেনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ওঁরা।
ঝিনুক পুরনো দিনের বাঙালি খাবার পছন্দ করত। শাকের চচ্চড়ি বা মোচার ঘণ্ট ছিল ওর অত্যন্ত প্রিয়। নিজে হাতে জোয়ানের মিশ্রণ তৈরি করত। সেটা নাকি ছিল ওর বাবার রেসিপি। আমি আবার সেটা খুব পছন্দ করতাম বলে আমাকেও দিয়েছিল। নিজের হাতে বড়ি দিতে পারত। পাশাপাশি ওর আতিথেয়তার কোনও তুলনা চলে না। ওখানে কেউ হয়তো বাড়ি বদলাবে বা দেশে ফিরে আসবে, জানতে পারলেই শেষের কয়েকটা দিন তাদের নিজের বাড়িতে ডেকে খাবার খাওয়াত ঝিনুক। হোটেলের কথা উঠলেই বলত, ‘‘আমি ও সব কিছু জানি না! আমাদের বাড়িতেই তোমাদের খেতে হবে।’’ এক বছর পর আমরা যখন দেশে ফিরে আসছি, তখনও শেষের কয়েকটা দিন আমরা ঝিনুকের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করেছিলাম। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে এতটা পরিণত চিন্তাভাবনা কিন্তু সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু ঝিনুক ছিল ব্যতিক্রম।
ঝিনুকের হাতের কাজও ছিল চমৎকার। গৃহস্থালির ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে কী সুন্দর সব জিনিসপত্র তৈরি করত ও। লুডো খেলতে ভালবাসত। কত রাত আমরা দুই পরিবার একসঙ্গে লুডো খেলে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। মনে পড়ছে ঝিনুকের একটা বিড়াল ছিল। নাম ছিল ‘বেনো’। তাকে নিয়েও কত গল্প করত ঝিনুক।
আমি নিজে খুব একটা ধার্মিক নই। কিন্তু ঝিনুক নিষ্ঠা ভরে পুজোআচ্চা করত। সন্তোষী মায়ের ব্রত করত। সেটা দেশে কোনও কারণে সম্পূর্ণ হয়নি বলে, নেদারল্যান্ডসে আমরা ভালমন্দ খাচ্ছি, ঝিনুক কিন্তু আমাদের সামনেই রুটি আর আলুভাজা খেয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করতেই ও ব্রতর কথা জানাল। সরস্বতী পুজোয় পরিপাটি করে হলুদ শাড়ি পরে আমার দুই ছেলেকে অঞ্জলি দেওয়া শিখিয়েছিল। বাড়িতে টিভির নীচে ছিল ওর ছোট্ট ঠাকুরঘর। পুজোর জন্য আলাদা করে দুধ কিনে আনা, ফুল বা ফল কিনে আনা— ওর মতো যত্ন নিয়ে পুজো আমি করতে পারব না।
ঝিনুক যখন ক্লাস টেনে পড়ে, তখন ওর মা প্রয়াত হন। বাবা সোদপুরে একাই থাকেন। বাবার চোখের ছানি অপারেশন নিয়েও খুব চিন্তায় থাকত। আমার কাছে ওর মায়ের কথা খুব বলত। ঈশ্বর হয়তো এতটা নির্দয় না হলেও পারতেন। আমার ছোট বোনকে এত তাড়াতাড়ি আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন!
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)