এক নম্বর নায়িকা হয়ে থাকার ইচ্ছে ছিল না। বরাবর চেয়েছেন সুঅভিনেত্রী হতে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যক্তিত্ব আর প্রতিভার জোরে নিজের জায়গা পাকা করেছেন। তিনি বাঙালির চিরকালীন নন্দিনী—তনুজা।
জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। বাবা কুমারসেন সমর্থ পরিচালক। মা শোভনা সমর্থ অভিনেত্রী। শৈশবে মায়ের হাত ধরেই হাতেখড়ি অভিনয়ে। পারিবারিক ধারা মেনে তনুজা তৃতীয় প্রজন্মের অভিনেত্রী। তাঁর দিদিমা রত্তন বাঈ ছিলেন নির্বাক যুগের নায়িকা।
তনুজার পড়াশোনা পঞ্চগনির সেন্ট জোসেফ স্কুলে। তারপর সুইৎজারল্যান্ডের সেন্ট জর্জেস স্কুল। তারপর আর কলেজে যাননি তনুজা। নিজেকে ডুবিয়ে দেন অভিনয়ে।
শৈশব থেকেই বিচ্ছেদ দেখেছেন তনুজা। তিনি যখন স্কুলপড়ুয়া, ডিভোর্স হয়ে যায় শোভনা-কুমারসেনের। অভিনেতা মতিলালের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শোভনা। কিন্তু বিয়ে আর করেননি। সিঙ্গল পেরেন্ট হয়ে বড় করেন চার মেয়ে এবং একে ছেলেকে।
শোভনা সমর্থের সন্তানদের মধ্যে তনুজা ও নূতন অভিনেত্রী হয়েছেন। বাকি দুই মেয়ে চতুরা, রেশমা এবং ছেলে জয়দীপ দূরেই থেকেছেন অভিনয় থেকে। মায়ের পরিচালনায় সাত বছরের তনুজার আত্মপ্রকাশ ‘হমারি বেটি’ ছবিতে, ১৯৫০ সালে।
নায়িকা হিসেবেও তনুজার প্রথম ছবি মায়ের নির্দেশনাতেই। ১৯৬০ সালে ‘ছাবিলি’ ছবিতে। তার পরের বছর নায়িকার ভূমিকায় এল সাফল্য, ‘হমারি ইয়াদ আয়েগি’ ছবিতে।
এরপর ‘বাহারেঁ ফির ভি আয়েঙ্গি’, ‘জুয়েল থিফ’, ‘হাতি মেরে সাথি’, ‘দূর কা রাহি’, ‘মেরে জীবনসাথি’, ‘দো চোর’, ‘ভূত বাংলা’, ‘দো দুনি চার’, ‘প্রেম রোগ’... একের পর এক সাফল্য।
ছয়ের দশক থেকে বাংলা ছবিতে অভিনয় শুরু তনুজার। প্রথম ছবিতেই উত্তমকুমারের নায়িকা। ১৯৬৩ সালে চূড়ান্ত সফল তাঁদের ছবি ‘দেয়া নেয়া’। তাঁদের রসায়ন বক্সঅফিসে সফল হয়েছে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘রাজকুমারি’ ছবিতেও।
উত্তমকুমারের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তনুজার জুটি জনপ্রিয় এবং সফল। ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে নন্দিনীর উদ্দেশে সৌমিত্রর টুইস্ট তো আইকনিক। কিংবা ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবিতে এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে চলে গিয়ে মনটাকে হারাবার হাতছানিই বা কে উপেক্ষা করতে পারে! ( ছবি: টুইটার)
নায়িকা থেকে ক্রমে চরিত্রাভিনেত্রী। বছরে খুব বেশি ছবি না হলেও অভিনয়কে বিদায় জানাননি তনুজা। কাজ করছেন টিভি সিরিজেও। বাংলা ভাষায় বহু দিন পরে ২০১৮ সালে অভিনয় করলেন ‘সোনার পাহাড়’ ছবিতে। বক্সঅফিস এবং সমালোচক মহল, দু’দিকেই সাফল্য পেয়েছে তনুজার কামব্যাক-অভিনয়।
১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন তনুজা। বিখ্যাত বলিউড প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের ছেলে সমু মুখোপাধ্যায়কে। তাঁদের বড় মেয়ে কাজল বলিউড শাসন করেছেন দাপটের সঙ্গে। ছোট মেয়ে তনিশাও অভিনয় করেছেন কিছু ছবিতে। ২০০৮ সালে প্রয়াত হন সমু।
বিয়ের দশ বছর পর থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন তনুজা। তবে তিনি আর সমু ডিভোর্স করেননি কোনও দিন।
অভিনয়ের পাশাপাশি তনুজা ভালবাসেন সিনেমা দেখতে, বই পড়তে আর নতুন ভাষা শিখতে। বাংলা ছবিতে কোনওদিন ডাবিং করাননি। বাংলা উচ্চারণে সমস্যা থাকলেও, সংলাপ বলেছেন তিনি নিজেই।
সমাজকর্মী তনুজা বরাবরই স্পষ্টবাদী। জীবনের বাঁকে কোনও কিছু নিয়েই তাঁর লুকোচুরি নেই। বরং প্রকাশ্যে তাঁর ধূমপান অনেক সময়েই বিতর্ক ডেকে এনেছে।
নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা তনুজা পরিচিত হতে চেয়েছেন অভিনেত্রী হিসেবে। অভিনয়ের সুযোগ থাকলে দ্বিধা করেননি পার্শ্বনায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতেও। নিজের ছন্দেই দর্শকদের হৃদয় হরণ করেছিলেন তনুজা। (ছবি:সোশ্যাল মিডিয়া)