মেয়ে চায়, মা-বাবা দু’জনেই ভাল থাক, সুখে থাক। ছবি: শ্রাবন্তীর পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।
মেয়ে তাঁকে ডাকে ‘বাবি’ বলে।
অন্য অনেক আহ্লাদী সম্বোধনের সঙ্গে বেশ কয়েক দশক আগেই আধুনিক আদুরে বাঙালির ডাকে ‘বাবা’ হয়ে গিয়েছেন ‘বাবি’। এতে অস্বাভাবিকতা কিছুই নেই। তবে শ্রাবন্তী ভট্টাচার্যের বাড়িতে এই ডাকে রয়েছে অভিনবত্ব। আসলে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটি ‘বাবি’ বলে যাকে ডাকে, সে তার জন্মদাত্রী।
ছোটবেলা থেকেই সেই মেয়ে শুধু মাকে পেয়েছে পাশে। বাবা আছেন বটে, তবে নিত্য আবদারে আর জড়িয়ে ধরা আবেশে হাত বাড়ালে পাওয়া যায় শুধু মা ওরফে ‘বাবি’-কে। স্কুলে যাওয়ার সময় এখন সে নিজেই গুছিয়ে নিতে শিখেছে টিফিন, কারণ কাজের চাপে বাবি পারে না সব সময়। বাবির ক্লান্ত মুখ দেখলে কষ্ট হয়, বাবি যেন ভাল থাকে এইটুকু শুধু চাওয়া।
নাচ আর অভিনয় নিয়েই শ্রাবন্তীর জীবন। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ওয়েব সিরিজ় ‘বিরহী’-র জমিদার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন শ্রাবন্তী। তার পর মঞ্চে ‘তিতুমির’-এর জঞ্জালি, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এর যমরাজ, বা একেবারে আলাদা ‘মিত্রকে লইয়া কী করিতে হইবে’-এর সালমা; অথবা, ওয়েব সিরিজ় ‘রাজনীতি’-র রিঙ্কু হিসেবে অন্যধারার অভিনয়ে ধীরে ধীরে জমিয়ে তুলছেন আসর। মাত্র কয়েক বছরেই মঞ্চ বা ওটিটি-তে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন। পথটা মোটেও সহজ ছিল না।
পিতৃদিবসের আগে, শ্রাবন্তীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল পিতৃত্ব নিয়ে। নিজের বাবাকে নিয়ে যথেষ্ট অধিকারবোধ কাজ করে শ্রাবন্তীর। ২০১৭ সালে হারিয়ে গিয়েছেন সেই মানুষটি, তবু রয়ে গিয়েছেন মেয়ের মনে। শ্রাবন্তী বলেন, “আজ আমি যা কিছু, সবই বাবার জন্য। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারি, মানুষকে মানুষ বলে জ্ঞান করি, মানুষের জন্য সাহস দেখাতে পারি, সে কেবল বাবারই শিক্ষা। শুধু মানুষ কেন, পশু পাখির প্রতি প্রেমও বাবাই জাগিয়ে তুলেছিলেন।”
আসলে বাবা শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক অনুভূতি। আবার সমাজ সংস্কার বলে দেয় বাবাকে ঠিক কেমন হতে হবে। বাবার চেহারা হবে দারুণ শক্তপোক্ত, মায়ের মতো কোমল নয়। শুধু কাজ নয়, বাবার চেহারাও ঠিক করে দেয় সমাজ।
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই শ্রাবন্তীর চেহারার গড়ন বা স্বভাব তথাকথিত কোমল নয়। বরং তাঁর হাতের পেশি শক্ত, ঠোঁটের উপর হালকা রোমের ছোঁয়া, ঋজু শিরদাঁড়া, বিনা প্রশ্নে সব মেনে না নেওয়াই তাঁর স্বভাব। এ সব কিছু স্বাভাবিক হলেও সমাজ স্বাভাবিক মনে করে না। বিশেষত, ছোট থেকে যে সব প্রতিষ্ঠানে নাচ শিখেছেন শ্রাবন্তী, সেখানে নাকি এই সব কারণে রীতিমতো কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। হাঁটাচলায় দাপট থাকাও সেখানে ‘অপরাধ’।
কিন্তু একটা সময়ের পর মেয়ের কাছে ‘বাবি’ ডাক শুনলে মনের মধ্যে পরিপূর্ণতা আসে বই কি! যদিও ‘একাকী মা’ হিসেবে নিজেকে দেখতে রাজি নন শ্রাবন্তী। মেয়ের বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলেও, মেয়ের জন্য তাঁরা দু’জনেই আছেন। মায়ের মতো বাবাকেও পায় কিশোরী মেয়েটি, যখনই প্রয়োজন হয়। সে রকম ভাবনা থেকেই সম্পর্কের বুনটে রয়েছেন শ্রাবন্তী। তিনি বলেন, “ওর বাবা আছেন, আমার মেয়ে যখন খুশি বাবাকে পায়। আমরা দু’জন খুব ভাল বন্ধু, আগে ছিলাম, এখনও আছি। মেয়ের জন্য সেই বন্ধুত্বের যোগাযোগটাও অবিচ্ছিন্ন। তাই সেই অর্থে আমি একাকী মা নই।”
তবু মেয়ের সব আবদার, আহ্লাদ, চাওয়া-পাওয়া সব সময় সামাল দিতে হয় মা ওরফে ‘বাবি’-কেই। আর এই সময় বার বার মনে পড়ে নিজের বাবার কথা। নিজের বাবাকে নিয়ে শ্রাবন্তী খুবই অধিকারপ্রবণ। এমনকী সমাজমাধ্যমে ছোটবেলার ছবি ভাগ করার সময়ও ছোট করে ছেঁটে ফেলেন অন্য তুতো ভাইবোনেদের। যাতে বাবার কোলে শুধু তাঁকেই দেখা যায়।
কিন্তু তাই বলে বাবার সঙ্গে মেয়ের কি দ্বন্দ্ব তৈরি হবে না! এমন হয় না। শ্রাবন্তী বলেন, “একটা জায়গায় বাবার সঙ্গে আমার ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। সেটা শেষ পর্যন্ত মেটেনি।” বাবা ভাবতেন, নাচ বা অভিনয় শেখা হয়েছে, তাই যথেষ্ট হয়েছে। এগুলি পেশা হয়ে উঠতে পারে না। তাই শ্রাবন্তী দীর্ঘ দিন শিক্ষকতার চাকরি করেছেন কলকাতার এক বিখ্যাত বেসরকারি স্কুলে। বাবা মারা যাওয়ার পর সেই পেশা ত্যাগ করে ফেলেছেন। এখন শুধুই মঞ্চ।
শ্রাবন্তীর আক্ষেপ, ‘‘বাবা দেখে যেত পারল না, আমি সত্যিই নাচ বা অভিনয় নিয়েও সফল হতে পারছি। এ ভাবেও সফল হওয়া যায়। দেখলে খুব খুশি হত, আমি জানি।’’
তবে মেয়ের সঙ্গে নিজের স্বপ্ন ভাগাভাগি করে নেন ‘বাবি’। ছোট্ট মেয়েরও হাতেখড়ি হয়েছে নাটকে। মেয়ে কিন্তু বাবা-মা দু’জনের কথাই ভাবে সব সময়। যে কোনও উপায়ে বাবা মা সুখে থাকুক, এটাই প্রার্থনা তার।