বাঁ দিকে লাকি মুখোপাধ্যায়। ডান দিকে বিভিন্ন বয়সি কাননদেবীরা : নিজস্ব চিত্র।
যে যাঁর খরচে বিমানে কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন। ৫৪ জনের দল। তাঁরা পেশায় কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউ বা উকিল। সকলেই কাজ করেন বড় বড় সংস্থায়। কিন্তু এসেছেন থিয়েটার করতে। কেন হঠাৎ কাননদেবীকে নিয়ে নাটক করছেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা? উদ্যোক্তা লাকি মুখোপাধ্যায়। যিনি এই দলের মধ্যমণি। নাটকের পরিচালক। দলের নাম আনন্দম। আনন্দবাজার অনলাইনকে লাকি শোনালেন তাঁর অবিশ্বাস্য যাত্রাপথের কাহিনি, যা গল্প হলেও সত্যি।
গত ৬০ বছর ধরে লাকি মুম্বইয়ের বাসিন্দা। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তবু লোকে তাঁকে চেনে নাট্যব্যক্তিত্ব হিসাবেই। অবসর জীবনও কাটছে নাটক নিয়েই। তাঁর অবসর নেওয়ার সময় কই?
কলেজে বহুভাষী ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন। হুজুগে পড়ে থিয়েটার করা শুরু করেছিলেন। মুম্বইয়ের বাঙালিরা জড়ো হয়েছিলেন লাকির সঙ্গে। বনফুল কিংবা সমরেশ বসুর লেখাকে নাট্যরূপ দিয়ে তাঁরা বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করতেন ছাত্রজীবনে। বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ও করেছেন পরে। নেশার মতো হয়ে গিয়েছে তত দিনে, তাই চাকরিজীবনেও সময় বার করে নিতেন। তবে নাটকটা শখেই করতেন লাকি। শো করে টাকাও পেতেন অল্পস্বল্প। যদিও সেই শখ প্রয়োজনে বদলে যেতে বেশি দেরি হল না।
লাকির স্ত্রী তনুশ্রী মুখোপাধ্যায়ও আনন্দম-এই অভিনয় করতেন। তনুশ্রীর যখন ৪৩ বছর বয়স, ক্যানসার থাবা বসাল । সে সময় কলকাতায় কর্মরত লাকি। চাকরি ছেড়ে মুম্বই ফিরে যান। কোলন ক্যানসার, সারার সম্ভাবনা নেই। স্ত্রীর চিকিৎসার যাবতীয় খরচ জোগাতে হাত বাড়িয়ে দেন বন্ধুরাও।
লাকির কথায়, ‘‘এই সময় ক্যানসার রোগটাকে কাছ থেকে দেখি। বার বার হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে বলে দেখেছি, রোগী ও তাঁর পরিবারের কী দারুণ আর্থিক সঙ্কট! মানসিক-শারীরিক ভাবে তাঁদের নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখেছি। আমায় আমার অফিসের বসেরা সে সময়ে অনেক আর্থিক সাহায্য করেছেন, বিদেশ থেকে নতুন নতুন ওষুধ আনিয়ে দিয়েছেন। তবু বাঁচাতে পারলাম না।’’
‘আনন্দম’ মুহূর্ত নিজস্ব চিত্র।
একই সঙ্গে লাকি বুঝেছিলেন যাঁদের সামর্থ নেই, তাঁরা কী করে মোকাবিলা করবেন? অসুস্থ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যখন হাসপাতালে যেতেন, দেখেছেন বেড জোটেনি, হাসপাতালের বাইরে শুয়ে ছটফট করছেন অগণিত রোগী। লাকি বললেন, ‘‘৫ বছর ধরে ভুগে তনুশ্রীর শরীর আর ওষুধের অত্যাচার নিতে পারছিল না। ১৯৯৯ সালের ১৭ জুলাই সে চলে যায়। পরের দু’বছর একটাও নাটক করিনি। করতে পারিনি। তৃতীয় বছরে ছোট ছোট নাটক লিখতে শুরু করলাম। মনে হল অনেক কাজ বাকি আছে।’’
চোখের সামনে ক্যানসার আক্রান্ত অসহায় মানুষগুলোর মুখ ভাসত। লাকি জানান, নাটক দিয়েই নিজের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সে বার কাজ শুরু করলেন। সঙ্গী হলেন আনন্দম-এর সহশিল্পীরা। দেশের একের পর এক শহরে প্রযোজনার মাধ্যমে গত ১২ বছরে ক্যানসার আক্রান্তদের চিকিৎসায় আনন্দম তুলে দিয়েছে ১ কোটি ৬ লক্ষ টাকা। কলকাতায় আসছেন এ বার আরও বড় লক্ষ্যে। দলের কেউ পারিশ্রমিক নেবেন না। দুটি শো থেকে যা টাকা উঠবে, তার সবটাই যাবে ক্যানসার চিকিৎসা এবং সোনাগাছির যৌনকর্মীদের শিশুকল্যাণে।
মঞ্চে লাকি মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
হঠাৎ কাননদেবীকে নিয়ে নাটক কেন? পরিচালকের দাবি, কাননের অভিনয়, গানে বাঙালি মুগ্ধ হলেও কদর করতে পারেনি তাঁর জীবনসংগ্রামের। লাকি বলেন, ‘‘নারীশক্তির জয়ধ্বনির মাঝে কাননদেবীর মতো শক্তিশালী নারী তেমন গুরুত্ব পায়নি বলেই মনে হয়। আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’-তে তিনি লিখে গিয়েছেন সমাজের প্রান্ত থেকে উঠে এসে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে খ্যাতি, সম্মানের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করার কথা, কঠিন জীবন সংগ্রামের কথা, ‘কাননবালা’ থেকে ‘কাননদেবী’ হয়ে ওঠার কথা। সেই নিয়েই নাটক। ৯ থেকে ৭৬ বছর বয়সি ৫ জন নারী কাননবালা ও কাননদেবীর চরিত্রে অভিনয় করবেন।’’
আগামী ৫ ও ৬ নভেম্বর সন্ধেবেলা মঞ্চস্থ হবে ‘কাননবালা থেকে কাননদেবী’ নাটক। প্রথম শো অ্যাকাডেমিতে, দ্বিতীয়টি মধুসূদন মঞ্চে।