তথাগত মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
আলমবাজারে আমাদের ৩০০ বছরের পুরনো বাড়ি ছিল। বাড়ির ভিতরে একটা সময় কালীপুজো হত। বাড়ির নীচে ছিল সুড়ঙ্গ, গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই বাড়ি ভেঙেচুরে এখন নতুন ভাবে তৈরি হয়েছে। তবে কালীপুজো এখনও হয়। আমাদের বাড়িতে পাথরের কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আমার বাবা নিজেই প্রতি বছর পুজো করেন। আগে প্রতি বছর আমরা কালীপ্রতিমা নিয়ে আসতাম। একটা সময়ে পাড়ার প্রচুর লোকজন আসতেন পুজোয়। এখন বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। ভোগের রান্না মা নিজেই করেন। বাকিটা বাইরে থেকে বরাত দিয়ে আনানো হয়।
সমস্ত নিয়মরীতি মেনেই বাবা পুজোটা করেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে পশুবলি প্রথা নেই। আজ বলে নয়, কোনও দিনই এই প্রথা আমাদের বাড়িতে ছিল না। চালকুমড়ো বলি হয়তো হয়েছে। আসলে, বলি তো দেওয়া হয় উৎসর্গ করতে। অর্থাৎ কিছু পাওনাগণ্ডার আশায় উৎসর্গ করা হয়। আমাদের বাড়ির সংস্কৃতিতে কখনও ভগবানের সঙ্গে বিনিময় শেখানো হয়নি। আমাদের সব সময় ঈশ্বরকে বা ভগবান নামক ধারণাকে ভালবাসতে শেখানো হয়েছে। কিছু দিলে, তার বিনিময়ে ভগবান কিছু দেবেন, এমন আমাদের কখনও শেখানো হয়নি। বলিপ্রথা আসেই সেই আদানপ্রদানের মানসিকতা থেকে। এই সংস্কৃতি বা মানসিকতাকে আমার পরিবার কোনও দিনই সমর্থন করেনি, যার বিরুদ্ধে আমাকে কখনও যেতে হয়েছে।
আমাদের পুজোয় নিরামিষ পদ্ধতিতে মাংস রান্নারও কোনও ব্যাপার নেই। এ তো মানুষের তৈরি করা কিছু নিয়ম। কালী ঠাকুর কি নিজে কখনও এসে বলেছেন, আমাকে মাংস খাওয়াও। কালী ঠাকুর তো নারী শক্তি উদ্যাপনের প্রতীক। এক মহিলার মধ্যে যে শক্তি পুঞ্জীভূত রয়েছে, তা প্রকাশের একটা রূপ হলেন কালী। নারীশক্তির যোদ্ধা রূপ। এই সবের সঙ্গে নিরামিষ পদ্ধতিতে মাংস ইত্যাদির কোনও সম্পর্কই নেই। এ সব অশিক্ষিতদের সংস্কৃতি। মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে কিছু নিয়ম বানিয়েছে। ভক্তি বিষয়টাই সম্পূর্ণ ভিতর থেকে আসে। যাঁর ভক্তি আছে, তিনি একটা চেয়ারকেও ঈশ্বর মনে করে পুজো করতে পারেন। ভক্তি থাকলে সেই পুজো থেকেও তিনি ফল পাবেন। মূর্তি বা প্রতিমা এক ধরনের বিশ্বাস প্রকাশের রূপ মাত্র। যাঁরা নিরাকার ঈশ্বরকে পুজো করেন, তাঁদের কি ভক্তি নেই! এ সবই ধারণা।
তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে কালীপুজোর প্রসঙ্গ আসে। সেখানে রীতি হিসাবে হয়তো মাংস বা মদের উপস্থিতি থাকে। কোনও সাধক এই বিষয়টাকে আরও ভাল করে বলতে পারবেন। তবে কালীপুজোর সঙ্গে সরাসরি মাংসের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি মানুষের খাদ্যাভাসের কথা বলছি না। বাস্তুতন্ত্র স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষ সর্বভুক। খাওয়াদাওয়া কে কী করবে, তা নিজস্ব অভিরুচি। কিন্তু এর সঙ্গে ভক্তি বা পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। ঠিক যেমন মহিলাদের ঋতুস্রাবের সঙ্গেও পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই।