রাজ কপূর (বাঁ দিকে) আয়োজিত হোলি পার্টিতে অংশ নিতেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
একটা সময়ে প্রত্যেক বছর চুটিয়ে দোল খেলতাম। কিন্তু এখন বয়স বেড়েছে। দোলের দিন আমি সাধারণত বাড়িতেই থাকি। ছোটরা পায়ে আবির দেয়। আমি মা-বাবার ছবিতে একটু আবির দিয়ে দিই। তা ছাড়া অনেক বছর আগে দোল খেলার পর চর্মরোগ দেখা দেয়। চিকিৎসক বললেন, আর দোল খেলা যাবে না! কিন্তু দোল না খেললেও দোল নিয়ে আমার প্রচুর স্মৃতি।
কলকাতায় যখন নাটকে অভিনয় করি, তখন থিয়েটার পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে প্রত্যেক বছর দোল খেলতাম। মনে আছে, বড়বাজারের একটি দোকান থেকে সিদ্ধি কেনা হত। তার পর ধীরে ধীরে ছবিতে অভিনয় করতে শুরু করলাম। ষাটের দশকের শুরু, তখন উত্তমকুমারের বাড়িতে প্রত্যেক বছর নিয়ম করে যাতায়াত শুরু হল। তরুণকুমার এবং বরুণকুমার আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। সেই সূত্রেই যাতায়াত। আমরা সব সকালে দাদার গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে হাজির হতাম। মাসিমা, মেসোমশাই তখন সবাই বেঁচে। এলাহি আয়োজন— রকমারি খাবার, তার সঙ্গে বিয়ার। আর সিদ্ধি তো থাকতই। রং খেলে দুপুরের দিকে আমরা সবাই বাড়ি চলে যেতাম। তার পর সন্ধ্যায় আবার দাদার বাড়িতে উপস্থিত হতাম। গানের জলসা হত। সঙ্গে চলত মদ্যপান। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মতো শিল্পীরা গান গাইতেন। উত্তমদা নিজেও সকলের সঙ্গে গলা মেলাতেন। ভোর পর্যন্ত চলত সেই আড্ডা।
তার পর হেমন্তদা (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) আমাকে নিয়ে বম্বে চলে এলেন। এখানে এসে দেখলাম, তারকারা সকলেই হোলি উদ্যাপন করেন। বম্বেতে আমার তখন ধীরে ধীরে পরিচিতি তৈরি হয়েছে। রাজসাহেব (রাজ কপূর) তো কলকাতার মানুষ ছিলেন। খুব ভাল বাংলা বলতে পারতেন। আমাকে বিশু বলে ডাকতেন। কলকাতায় পরিচালক সুশীল মজুমদারের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন রাজসাহেব। এক বার তাঁর সঙ্গে তোলা ইউনিটের একটা গ্রুপ ছবি সুশীলদা আমার হাতে মুম্বই পাঠালেন। আরকে স্টুডিয়োয় তখন ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়’ ছবিটির শুটিং চলছে। আমি গিয়ে দিতেই তিনি চমকে উঠেছিলেন। বললেন, “বিশু, এ ছবি তুই কোথায় পেলি!” ওঁকে বিষয়টা বলতেই খুব খুশি হয়েছিলেন।
রাজসাহেব কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীনও দোল খেলতেন। সেই গল্প আমি তাঁর মুখই শুনেছিলাম। দোলের আগে আমাকে হঠাৎ একদিন বললেন, “বিশু কলকাতায় এত দিন দোল খেলেছিস। এ বার কাল আমার হোলি পার্টিতে চলে আয়।” সেই আমার আরকে স্টুডিয়োজ়ের হোলি পার্টিতে প্রথম যাওয়া। আর রাজসাহেবের সব কাজের মধ্যেই একটা রাজকীয়তা ছিল। দোলের রং থেকে শুরু করে খাবার, মদ— সব কিছুর মধ্যেই চমক থাকত। ওখানে একটা চৌবাচ্চা ছিল। তার মধ্যে সকলে একে অপরকে চুবিয়ে দিতেন। তখন তো চিন্টু (ঋষি কপূর), রণধীর কপূর কত ছোট। হাফ প্যান্ট পরে রং খেলত। সে সব দিনের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। কৃষ্ণা বৌদি (রাজ কপূরের স্ত্রী কৃষ্ণা মলহোত্র) সকলকে আদর আপ্যায়ন করতেন।
আরকে স্টুডিয়োর পার্টিতে তখন সারা বলিউড যেন ঝাঁপিয়ে পড়ত। কে নেই! অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে সেই সময়ের তারকাদের মধ্যে প্রাণ, রাজেন্দ্র কুমার, সিম্মি গারেওয়াল, কামিনী কৌশল আরও অনেকে। ঢোল বাজিয়ে গান হত, ভাং খাওয়া হত। শঙ্কর-জয়কিশন, শৈলেন্দ্র, রাধু কর্মকার গান গাইতেন। বাকিরা মিলে নাচতেন। শুধু অভিনেতারা নন, সেই সময়ে বম্বে শহরের প্রশাসনিক কর্তা থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ী— প্রত্যেকে আরকে স্টুডিয়োর পার্টিতে আসতেন। কেউ এই পার্টিটা হাতছাড়া করতে চাইতেন না। একটা দিন কাজের বাইরে সব তারকারা এক ছাদের নীচে। আড্ডা-গল্পে দিনটা কাটত।
সন্ধ্যায় আরও একটা পার্টির আয়োজন করতেন রাজ সাহাব। সেখানেও ভিড়। কোনও রকমে সকালের রং পরিষ্কার করে আবার শুরু হত উদ্যাপন। সেখানে রাতের দিকে দিলীপ কুমার আসতেন। ভোর পর্যন্ত চলত পার্টি।
পরবর্তী সময়ে রাজসাহেব চলে গেলেন। আরকে স্টুডিয়োর পাশাপাশি মুম্বইয়ে অমিতাভের বাড়িতে হোলির পার্টি খুব বিখ্যাত হতে শুরু করল। প্রচুর মানুষ আসতেন। ওই পার্টিতে ড্যানির কথা খুব মনে পড়ে। সকলকে মাতিয়ে রাখত ও। অমিতাভ দোলের দিন নিজে গলা ছেড়ে সকলের সঙ্গে গান গাইত। কী মজা করতাম আমরা!
দর্শকের হয়তো মনে আছে, ‘দো দিল’ ছবিতে মান্না দের গাওয়া হোলির গানে তো আমি লিপ দিয়েছিলাম। আমার নায়িকা ছিল রাজশ্রী। বম্বের দোল নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। কিন্তু হয়তো বয়সের কারণে কিছু কিছু ভুলেও যাই। এখন তো শুনি, ছোট ছোট করে ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতারা নিজেদের হোলি পার্টির আয়োজন করেন। আরকে স্টুডিয়োও তো বিক্রি হয়ে গিয়েছে। শুধু পড়ে রয়েছে হোলির একরাশ স্মৃতিমেদুরতা। আপনাদের প্রত্যেকের দোল ভাল কাটুক। হ্যাপি হোলি।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)