Aparajita Adhya

হাসপাতাল থেকে এ কথাও শুনতে হয়েছে, করোনায় সব রোগী বেঁচে ফিরবেন এমন তো কোনও কথা নেই

আমি সাক্ষী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েরও। এই ঢেউ প্রথম বারের থেকেও মারাত্মক! কাউকে সময় দিচ্ছে না।

Advertisement

অপরাজিতা আঢ্য (অভিনেত্রী)

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২১ ১৭:১১
Share:

অপরাজিতা আঢ্য।

বলে না, বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়? কথাটা ভীষণ সত্যি। করোনার সময় আমি অন্তত আরও একবার বুঝলাম। নিজে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলাম গত বছর। ‘চিনি’ ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে। সেটা ছিল পুজোর সময়। বাড়ির সকলেই প্রায় করোনা আক্রান্ত। আমার থেকে শাশুড়ি, ননদ, খুড়শ্বশুর আক্রান্ত। কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমাদের কাউকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। অক্সিজেনের সমস্যাও ছিল না। তার পিছনে চিকিৎসক নিরূপ মিত্রের বড় ভূমিকা ছিল।
আমি সাক্ষী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়েরও। এই ঢেউ প্রথম বারের থেকেও মারাত্মক! কাউকে সময় দিচ্ছে না। সামলানো যাচ্ছে না। আর সেই ঢেউ ঠেকাতে গিয়ে মানুষ যেন মানবিকতা ভুলেছে। কেন এমন বললাম তার স্বপক্ষে উদাহরণ দিই? আমার পাশের বাড়িতে ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে এক দম্পতির বসবাস। খুব ভাল তাঁরা। আমার সঙ্গে যথেষ্ট সুসম্পর্ক। সেই ভদ্রলোক আচমকাই করোনা আক্রান্ত। ফোনে তাঁরা আমার থেকে সাহায্য চাইলেন। ভদ্রলোকের জ্বর, প্রবল শ্বাসকষ্ট। হাঁপানিও আছে। একটা হাসপাতাল, রেমডেসিভির ওষুধ জোগাড় করতে গিয়ে প্রাণান্তকর অবস্থা!
সেই সময় হাসপাতাল থেকে এ কথাও শুনতে হয়েছে, করোনায় সব রোগী বেঁচে ফিরবেন এমন তো কোনও কথা নেই! অসুস্থ ভদ্রলোকের স্ত্রী আমার থেকেও ছোট। তাঁদের ছেলেমেয়েরা আরও। ভদ্রলোককে বাঁচাতে সারাক্ষণ তাঁকে নিয়ে ছুটোছুটি করতে করতে একে একে সবাই আক্রান্ত। তাঁদেরও হাঁপানি রয়েছে। ভদ্রলোক যদিও আগের তুলনায় সুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাঁর স্ত্রীকেও। কিন্তু মেয়েকে এখনও কোথাও ভর্তি করা যায়নি। এ দিকে তাঁর অক্সিজেন লেভেল ওঠানামা করছে।
এই সময়েই আরও একটা বিষয় বিস্মিত, আহত করেছে আমাকে। প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায় সামাজিক দূরত্বের পাশাপাশি মানবিক দূরত্বও যেন গড়ে উঠেছে মানুষে মানুষে। এই দূরত্বের কারণেই আমার ১৫ বছর বয়সে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন আমার বাবা। অসুস্থ প্রতিবেশীদেরও প্রায় একই দশা। ভদ্রলোককে বাঁচাতে বাড়ির সবাই অসুস্থ অবস্থায় দৌড়েচ্ছেন। পাড়ার বাকিদের কটাক্ষ, ‘‘এই অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে!’’ শুনে হতবাক! আমি দেখেছি তাই জানি, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এতটাই ভয়ঙ্কর যে ঘুরে বেড়ানোর মতো অবস্থায় থাকে না কেউ। অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পৌঁছোতে পৌঁছোতে রোগী মরণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। এ এক অদ্ভুত রোগ।
আক্ষেপও হয়েছে, এঁরাই প্রতি বছর ঘটা করে বাড়ি বাড়ি চাঁদা তোলেন দুর্গাপুজো করবেন বলে। অথচ বিপদের দিনে কারওর পাত্তা নেই। কেউ এসে দাঁড়াচ্ছেন না। আমি বলছি না, কোভিড রোগীকে জড়িয়ে ধরতে। সামাজিক দূরত্ব মেনেও তো তাঁকে সমর্থন জানানো যায়। যেমন আমার চিকিৎসক। তিনি নিজে অসুস্থ। শুধু আমার অনুরোধে বাড়িতে থেকে নিজের চিকিৎসা করাচ্ছেন। কোথাও ভর্তি হননি। পাশাপাশি, আমার চেনাজানাদের চিকিৎসা করে চলেছেন অক্লান্ত ভাবে।
এই সময়েও আমরা যদি ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ সম্পন্ন ‘মানুষ’ না হই তা হলে আর কবে হব? তাই আমি বলি কি, অতিমারি আদতে ঈশ্বরের মার। তিনি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করে আমাদের পরখ করছেন। আমাদের মনুষ্যত্বের পরীক্ষা নিচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তার সত্যিকারের কোপে পড়তে না চাইলে পরস্পরের পাশে থাকুন।
শীতে যে পাতাগুলো গাছে থেকে যায় মরশুম শেষে তারাই কিন্তু বসন্তের যোগ্য দোসর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement