আরতি মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
বিশ্ব সঙ্গীত দিবস। আজ মনের মধ্যে মেঘ জমে আছে। গান আসছে…‘কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে’। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আজ শুধু ওই কণ্ঠস্বর,ওই মুখ মনে আসছে।
রেকর্ডিং রুমে প্রথম দেখা দিদিভাইয়ের সঙ্গে। আমি দিদিভাই বলেই ডাকতাম। আমি তখন খুব ছোট। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিশু শিল্পী হিসেবে ক্যালকাটা অর্কেস্ট্রা স্টুডিয়োয় গানের রেকর্ডিংয়ে গিয়েছিলাম। দূরে চুপ করে বসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। স্টুডিয়োয় সবাই আমাকে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে বললেন। সেই থেকে শুরু।
ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে তখন আমি বেশ পরিচিত। দিদিভাইয়ের সঙ্গেও গান রেকর্ড করছি। এই গানের মধ্যে দিয়েই কখন যেন উনি আমার অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের মধ্যে যখনই কথা হত গান নিয়েই কথা বলতাম আমরা। যে দিন আমার গানের রেকর্ডিং থাকতো সকালেই দিদিভাইয়ের ফোন, আমাকে গানের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের কথা মনে করিয়ে দিতেন। বাড়িতে ফিরেই আবার দিদিভাইয়ের ফোন। রেকর্ডিং কেমন হল জানতে চাইতেন। দিদিভাই তখন নিজেও গানের জগতে ব্যস্ত, তা-ও আমার খবর নিতে ভুলতেন না। ভাবা যায়?
বাচ্চা মেয়ের মতো বোঝাতেন আমাকে। কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে। গান রেকর্ডিংয়ের আগে বা অনুষ্ঠানের আগে কথা বলতে দিতেন না। নিজেও চুপ করে বসে থাকতেন। কারও সম্পর্কে ভাল ছাড়া কোনও খারাপ কথা বলতে শুনিনি। ফোনেও আমরা বিভিন্ন রাগ নিয়ে আলোচনা করতাম। আমি কোনও একটা রাগ গাইলে দিদিভাই আর একটা রাগ শোনাতেন। এই ভাবে কত সময় আমরা কাটিয়েছি। ওঁর স্বামী শ্যামলদার সঙ্গে সময় পেলেই পুদুচেরি চলে যেতেন। বলতেন, ‘‘ওখানে গেলে খুব শান্তি পাই’’।
কলকাতায় ওর বাড়িতে গেলেই দেখতাম, হারমোনিয়াম বের করে গাইতে বসে যেতেন। আমিও তানপুরা নিয়ে বসে পড়তাম। গানে গানে বিনিময়। একসঙ্গে রেওয়াজ করতাম। একটা বন্দিশ দিয়ে কী কী গান গাওয়া যায়, এই সবই ছিল আমাদের আড্ডার বিষয়।
জীবন কেটে যাচ্ছিল। এক দিন, তখন ঠাকুরঘরে আমি। ফোনে দিদিভাইয়ের চলে যাওয়ার খবর পেলাম। আমার হাত থেকে পুজোর ফুল পড়ে গিয়েছিল। এখন রোজই ঠাকুরঘরে বসে দিদিভাইয়ের কথা মনে পড়ে। আক্ষেপ হয়, শেষ সময়ে ওর কাছে থাকতে পারলাম না। শেষ বারের মতো ওঁর মুখটা দেখতে পেলাম না। গানের জগতের সেই ‘সরস্বতী’-কে হারিয়েছি আমরা। এই বিশ্ব সঙ্গীত দিবস শুধুই মন খারাপের।