৪০-এ পা রাখলেন বলিউডের মিষ্টি হাসির মেয়ে।
অভিনয়ের প্রতি টান সেই শৈশব থেকে। সুযোগ পেলেই স্কুলের নাটকে নাম লেখাতেন। মন দিয়ে ঝালিয়ে নিতেন সংলাপ। আলসে দুপুরে মায়ের সঙ্গে বসে সাদা-কালো টেলিভিশনে দেখে নিতেন কালজয়ী সব ছবি। তখনও দিয়া জানতেন না তাঁর জন্যই পথ চেয়ে বলিউড, চোখ ধাঁধানো জাঁকজমকের পৃথিবী। কিন্তু ধাপে ধাপে এগিয়েছিলেন সেই পথেই। তৈরি করেছিলেন নিজেকে। স্কুলের চেনা মঞ্চ থেকে ফিলিপিনসের ম্যানিলা। ২০০০ সালে মাত্র ১৯-এই জিতে নিয়েছেন ‘মিস এশিয়া প্যাসিফিক’-এর খেতাব।
তিনি দিয়া মির্জা। বৃহস্পতিবার, ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। ৪০-এ পা রাখলেন বলিউডের মিষ্টি হাসির মেয়ে।
১৯৮১ সালে হায়দরাবাদে দিয়ার জন্ম। বাবা ফ্র্যাঙ্ক হেন্ড্রিক ছিলেন জার্মান। মা দীপা দেবী বাঙালি। দু’জনেরই পেশা স্থাপত্যবিদ্যা কেন্দ্রিক। দিয়ার বয়স যখন মাত্র সাড়ে চার, তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। দীপা দেবী বিয়ে করেন আহমেদ মির্জাকে। দিয়ার নাম থেকে হেন্ড্রিক সরে গিয়ে জুড়ে যায় মির্জা।
স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার তাগিদ তাড়িয়ে বেড়াত। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাই চাকরি করেছেন দিয়া। এক সংস্থার মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদে নিযুক্ত ছিলেন বেশ কিছু দিন। তাই দশটা-পাঁচটার চাকরির পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছেন মডেলিং। বিভিন্ন নামী সংস্থার মুখ হয়ে উঠেছিলেন যুবতী দিয়া। এমনকি তামিল ছবিতে ‘এক্সট্রা’ও হয়েছেন নিঃসঙ্কোচে। অভিনয়ের সুযোগ খুঁজে চলেছিলেন হন্যে হয়ে। এর পরেই ‘মিস এশিয়া প্যাসিফিক’। বলিউডের দিকে এগিয়ে যান আরও এক ধাপ।
২০০১ সালে ‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’ ছবির হাত ধরে বলিউডে আত্মপ্রকাশ। বিপরীতে আর মাধবন। বক্স অফিসে ছবির ভাঁড়ার উপচে পড়েনি ঠিকই, কিন্তু প্রশংসিত হয়েছিলেন নবাগতা নায়িকা। ছবির গান, মাধবনের সঙ্গে তাঁর অম্লমধুর রসায়ন ঝড় তুলেছিল সিনেপ্রেমীদের মনে। প্রথম ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য না পেলেও তাই কাজের অভাব হয়নি দিয়ার। ছবি করে গিয়েছেন পর পর। যদিও সিংহভাগ ছবিই মুখ থুবড়ে পড়ে বক্স অফিসে। অভিনয় দিয়ে দর্শক মনে ছাপ ফেলতে পারছিলেন না কিছুতেই।
২০০০ সালে মাত্র ১৯-এই জিতে নিয়েছেন ‘মিস এশিয়া প্যাসিফিক’-এর খেতাব।
২০ বছরের সুদীর্ঘ কেরিয়ার। কিন্তু দিয়ার ঝুলিতে ‘সফল ছবি’র সংখ্যা লক্ষ্যণীয় ভাবে কম। তালিকায় চোখ বুলিয়ে মনে রাখার মতো কোনও চরিত্র তুলে আনতে বেগ পেতে হয় বৈকি! তার কারণ হিসেবে যদিও নিজের সৌন্দর্যকে খানিক দায়ী করেন আন্তর্জাতিক সুন্দরী। গত বছর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার রূপ অনেক সময়ই আমার পেশায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি চাকরি হারিয়েছি এবং একটি চরিত্রে আমাকে বাছাই করা হয়নি। কারণ আমি দেখতে সুন্দর। এটা একটা অদ্ভুত ধরনের অসুবিধা।”
শ্যামবর্ণ হওয়ার কারণে বলিউডে কাজ হারানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু দিয়ার ক্ষেত্রে উলট-পুরাণ। ‘অতিরিক্ত’ ফর্সা হওয়ায় নাকি অনেক চরিত্র হাতছাড়া হয়েছে তাঁর! অধরা থেকে গিয়েছে প্রত্যাশিত সাফল্য।
বলিউডে দু’দশক পার। তবু শাহরুখ-সলমন-আমিরদের মতো কোনও ‘খান’-এর সঙ্গে সফল ছবি নেই। অথচ তাঁদের সঙ্গে একের পর এক ছবি করে বক্স অফিসে ঝড় তুলেছেন তাঁরই সমসাময়িক প্রিয়ঙ্কা, করিনারা। যে ইন্ডাস্ট্রিতে এই তিন খানের সঙ্গে হিট ছবির সংখ্যা এখনও নায়িকাদের সাফল্যের মাপকাঠি বলে গণ্য হয়, সেখানে দিয়ার ‘স্কোর’ খুব ভাল নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর ঝুলিতে এসেছে ‘ক্যামিও’ চরিত্র। ‘ওম শান্তি ওম’, ‘কুরবান’-এর মতো ছবিতে কয়েক মিনিট মুখ দেখানোর সুযোগ পেয়েছেন শুধু।
‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন দিয়া।
তাই দিয়া চান বা না চান, এত বছর পরেও দর্শক দিয়াকে মনে রেখেছেন ‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’ দিয়েই। কিন্তু দিয়ার নিজের মনে কি এখনও এই ছবির বাস? দিন কয়েক আগে উত্তর দিয়েছেন নায়িকা নিজেই। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এক সময়ে বলিউডে নারীবিদ্বেষী ছবি তৈরি হত, গল্প লেখা হত। ‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’ও সে রকমই একটি ছবি। আর আমি সেই ছবিতে ছিলাম!”
দিয়া আগাগোড়াই এমন। বেপরোয়া, সাহসী। তাই কোনও কিছুর পরোয়া না করেই ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনে আমিরের পাশে ছিলেন। অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপির কাছেও। রাজনৈতিক শক্তিকে তোয়াক্কা করেন না যিনি, নিজের ছবির খুঁত ধরা যে তাঁর কাছে জল-ভাত, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না!
তবে বিতর্ক থেকে আগাগোড়াই নিজেকে দূরে রেখেছেন দিয়া। ব্যক্তি জীবনকে চর্চার খোরাক হতে দেননি সচেতন ভাবেই। ২০১৪ সালে বিয়ে করেছিলেন দীর্ঘ দিনের প্রেমিক, পেশায় ব্যবসায়ী সাহিল সঙ্ঘকে। পাঁচ বছরের মাথায় সেই সংসার ভাঙে। বিচ্ছেদ হয় সাহিল-দিয়ার। তবে দাম্পত্য ভাঙলেও তাঁদের বন্ধুত্ব এখনও অমলিন।
দিয়া সব ব্যর্থতা, শঙ্কাকে উড়িয়েছেন অবলীলায়।
ফের প্রেম আসে দিয়ার জীবনে। ব্যবসায়ী বৈভব রেখির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান নায়িকা। ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেছেন তাঁরা। চলতি বছরের মে মাসে পুত্রসন্তানের মা হয়েছেন দিয়া। একরত্তির নাম রেখেছেন অভ্যান আজাদ।
শারীরিক কিছু অসুবিধার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই সি সেকশন ডেলিভারির মাধ্যমে অভ্যানকে জন্ম দেন দিয়া। সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হওয়ায় আইসিইউ-তে রাখতে হয়েছিল দিয়ার সন্তানকে। চিকিৎসক এবং নার্সদের দেখাশোনায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে।
নায়িকা থেকে স্ত্রী, স্ত্রী থেকে মা— জীবনের প্রত্যেক ধাপে, প্রত্যেক চরিত্রে কঠিন পরীক্ষা তাঁর পথ চেয়ে থেকেছে। কিন্তু হার মানতে শেখেননি দিয়া। সব ব্যর্থতা, শঙ্কাকে উড়িয়েছেন অবলীলায়। পাশ করেছেন ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে।