চার দশকের অভিনয় জীবন। একশোর উপর সিনেমা। কপূর বংশের নীল রক্তে ভর করে নয়, নিজের অভিনয় দক্ষতাতেই রুপোলি পর্দায় অসংখ্য মণি-মানিক্য ছড়িয়ে রেখেছেন ঋষি কপূর। তার মধ্যে থেকে এক মুঠো সিনেমা বেছে নেওয়া বেশ কঠিন। আপনাদের জন্য রইল এমন কিছু সিনেমার নাম যা তাঁর কেরিয়ার তো বটেই বলিউডের ইতিহাসেও মাইল স্টোন হয়ে থাকবে। শুরু থেকেই শুরু করা যাক।
মেরা নাম জোকার (১৯৭০): ঋষির বয়স তখন ১৮। বাবা রাজ কপূরের স্বপ্নের প্রজেক্ট মেরা নাম জোকার। মুখ্য চরিত্রের নাম রাজু, অভিনয়ে রাজ কপূর স্বয়ং। আর তাঁরই ছেলেবেলার চরিত্রে ঋষি। সোয়া চার ঘণ্টার ছবি, বক্স অফিসে দাগ কাটতে পারল না। ডেবিউ ছবিতেই কিন্ত নীল চোখ, ফুটফুটে ফর্সা ছেলেটার সপ্রতিভ অভিনয় মন কাড়ল সকলের। প্রথম ছবিই ঋষি কপূরকে এনে দিল জাতীয় পুরস্কার। সেরা শিশু অভিনেতার জন্য।
ববি (১৯৭৩): সাতের দশকের দামাল সময়। সেপ্টেম্বরের শেষে ববি রিলিজ করল। ঋষির বিপরীতে নবাগতা বছর ষোলোর ডিম্পল। দু’জনের কেমিস্ট্রি ছিল শরতের আকাশের মতোই ঝলমলে। দুই কিশোর-কিশোরীর প্রেমের প্রেমের গল্প দেখতে দিনের পর দিন হাউসফুল থাকল সিনেমা হলগুলো। ‘ম্যায় শায়র তো নহি’-র সুরে সে সময় কত প্রেমিক যে নিজের মনের কথা বলতে চেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আর ‘হম তুম এক কমরে মে বন্ধ হো’ তো ক্লাসিক। সেরা অভিনেতা, অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার পেলেন ঋষি আর ডিম্পল।
অমর আকবর অ্যান্টনি (১৯৭৭): ৭০ মিলিমিটারে একসঙ্গে বিনোদ খন্না, ঋষি কপূর, অমিতাভ বচ্চন। বিপরীতে শবানা আজমি, নিতু সিংহ, পারভিন বাবি। অন্ধ মা, শৈশবে তিন ভাইয়ের বিচ্ছেদ আর যৌবনে দেখা, সব শেষে ভিলেনের পরাজয়। আবেগে মাখামাখি বলিউডের মশালা ফিল্মের নিখুঁত চিত্রনাট্য। ৭৭ সালে সব চেয়ে বেশি বাণিজ্য করা সিনেমার তালিকায় নাম লেখাল এই ছবি। ওই তারকাখচিত স্টারকাস্টের মাঝেও আকবর ইলাবাদির চরিত্রে অবিস্মরণীয় ঋষি। তাঁর লিপে ‘পর্দা হ্যায় পর্দা’ আজও সমান জনপ্রিয়।
কর্জ (১৯৮০): ১০ বছর আগে সিমি গ্রেওয়ালের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন মেরা নাম জোকারে। সেই সিনেমার স্কুল শিক্ষিকা সিমি সুভাষ ঘাইয়ের কর্জে ভ্যাম্পের চরিত্রে। নাচে, গানে জমজমাট পুনর্জন্মের গল্প সুপার-ডুপার হিট। এমন সেই সিনেমার ক্যারিজমা যে সাতাশ বছর পর শাহরুখ খানকে উদ্বুদ্ধ করল পুনর্জন্ম নিয়ে সিনেমা বানাতে। শাহরুখের সেই সিনেমার নামটাও কর্জের হিট সুপারহিট গান ‘ওম শান্তি ওম’ থেকে ধার নেওয়া।
চাঁদনি (১৯৮৯): একের পর এক ফ্লপ। মরিয়া যশ চোপড়া ফিরে গেলেন রোম্যান্টিক সিনেমার ফরমুলায়। এক দিকে শ্রীদেবী অন্যদিকে ঋষি কপূর আর বিনোদ খন্না। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। রোহিতের চরিত্রে ঋষি কপূর অভিনয়ে ছাপিয়ে গেলেন বিনোদ খন্নাকে। লোকমুখে আজও গুনগুন করে ‘চাঁদনি ও মেরি চাঁদনি’ গানটি। এই সিনেমার নাম বললে লোকের এখনও ঋষি-শ্রীদেবীর কেমিস্ট্রির কথাই মনে পড়ে। এই সিনেমার সুবাদেই সাফল্যের রাস্তায় ফেরেন যশ চোপড়াও।
হেনা (১৯৯১): কাঁটাতারের সীমানায় ছাপিয়ে এক প্রেমের গল্প। প্রধান চরিত্রে ঋষি, বিপরীতে পাকিস্তানি অভিনেত্রী জেবা বখতিয়ার। এটাই ছিল রাজ কপূর পরিচালিত শেষ সিনেমা। তাঁর প্রয়াণে অসমাপ্ত কাজ শেষে করেন রণধীর কপূর। শক্তিশালী অভিনয় আর কাশ্মীরের অপরূপ সব লোকশেন। এই সিনেমা মন ভরিয়েছিল দর্শকদের।
বোল রাধা বোল (১৯৯২):তত দিনে বলিউডে দু’দশক পার করেছেন ঋষি। তিন খানেরও আগমন ঘটেছে। কিন্তু সেই বাজারেও যে রোম্যান্টিক নায়কের চরিত্রে ঋষির গ্রহণযোগ্যতা কমেনি, তার প্রমাণ এই ছবির সাফল্য। ডেভিড ধওয়ানের সঙ্গে এটাই ঋষি কপূরের প্রথম সিনেমার। কুমার শানুর গান তখন হট কেক। তাঁর কণ্ঠে ঋষির লিপের ‘তু তু তু তু তু তারা’ ছিল বাম্পার হিট। ঋষি-জুহির কেমিস্ট্রিও ছিল এই সিনেমা ইউএসপি। সব মিলিয়ে বক্স অফিসে দারুণ সফল হয় এই ছবি।
অগ্নিপথ (২০১২): অমিতাভ বচ্চনের কিংবদবন্তি সিনেমার রিমেক। মুখ্য চরিত্রে হৃতিক রোশন। ভিলেনের চরিত্রে সঞ্জয় দত্ত। তারই মাঝে রউফ লালা নামে একটা ছোট্ট চরিত্রে করলেন ঋষি কপূর। এই প্রথম বার খলনায়কের চরিত্র। রোল ছোট তো কী। ড্রাগ কারবারির চরিত্র কাঁপিয়ে দিলেন ঋষি।
ডি-ডে (২০১৩): এ বার সিনেমার মূল খলনায়ক তিনিই। দাউদ ইব্রাহিমের আদলের তাঁর চরিত্র – নাম ইকবাল শেঠ ওরফে গোল্ডম্যান। তাকে ধরতেই গুপ্তচরদের অভিযান। লাল সানগ্লাস পরা সেই আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনের চরিত্র ভালই লেগেছিল দর্শকদের। অনেকে বলেন দাউদের উপর একাধিক সিনেমা হলেও সেই চরিত্রে ঋষি ছাড়া আর কাউকে অত ভাল মানায়নি।
কপূর অ্যান্ড সন্স (২০১৬): একেবারে ভিন্ন ধারার ছবি। আর এ বার নব্বইয়োর্ধ্ব দাদুর চরিত্রে ঋষি। অমরজিত মলহোত্রা নামে এমন একজন মানুষ যিনি কোনও ভাবে নিজের পরিবারকে ভাঙতে দিতে চান না। প্রস্থেটিক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেকআপ। ফাওয়াদ, সিদ্ধার্থ, আলিয়া - একঝাঁক তরুণ অভিনেতার মাঝেই দুর্ধর্ষ অভিনয় করলেন ঋষি। ফলও এল হাতেনাতে। বক্স অফিসে সফল হল ছবি। সেরা সহ-অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পেলেন ঋষি। এটাই তাঁর জীবনের শেষ ফিল্মফেয়ার।
শুধু এই ক’টা সিনেমাই নয়। কভি কভি, হম কিসি সে কম নহি, এক চাদর মইলি সি, দিওয়ানা, মুল্ক। আরও কত সিনেমার নাম যে মিস করলাম তার ইয়ত্তা নেই। এই সব সিনেমাগুলোর মধ্যে দিয়েই দর্শকরা মনে রাখবেন এমন একজন নায়ককে অভিনয়, নাচ, সেন্স অব হিউমারে যিনি সাধারণ চিত্রনাট্যকেও কে তুলতেন অসাধারণ।—ছবি পিটিআই।