হাত বাড়ালেই...। নিউ মার্কেট এলাকায় মহম্মদ সেলিম এবং সোমেন মিত্র।
প্যাচপেচে গরম ও ঠা-ঠা রোদেও ভেঙে পড়া উড়ালপুলের ছায়াটাই প্রকট।
বেলা অবধি লম্বা রোড-শোয়ে ঘেমেনেয়ে ফের রক্তদান শিবিরে ঢুঁ মারতে গিয়ে ডাকসাইটে বিদায়ী মন্ত্রী তা ভালই টের পেলেন। রবিবার, দুপুর। নতুনবাজারের ক্ষীরপট্টির পাশ দিয়ে পাথুরিয়াঘাটার টেগোর ক্যাসল চত্বরে ঢুকেই টাঙানো ছবিগুলো চোখে পড়ল শশী পাঁজার। ভেঙে পড়া উড়ালপুলের নীচে নিহত কানডোই দম্পতি বা তপন দত্ত, এই ২৪ নম্বর ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা ছিলেন। নিহত পড়শিদের ছবি টাঙিয়ে হিন্দিতে তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জোরকদমে চলছে রক্তদান।
বিদায়ী মন্ত্রী তথা শ্যামপুকুর কেন্দ্রে শাসক দলের প্রার্থী শশীর পার্ষদদের ফিসফাস কানে এল, আহা রে, অজয় কানডোই মানুষটা বড় ভাল ছিলেন। দুর্ঘটনার আগের সন্ধ্যায় পাথুরিয়াঘাটায় তৃণমূল কাউন্সিলর ইলোরা সাহার অফিসে বসেই আড্ডা দিচ্ছিলেন, কতক্ষণ।
শশীদেবী টেগোর ক্যাস্লে ঢোকার সময়েই রক্তদান শিবির ঘুরেটুরে বেরিয়ে গেলেন শ্যামপুকুরের বিজেপি প্রার্থী সোমব্রত মণ্ডল। একটুর জন্য শশীর সঙ্গে মুখোমুখি হল না তাঁর। তবে ‘উড়ালপুল হটাও অভিযান সমিতি’র মিছিলটার সঙ্গে মোলাকাত এড়ানো গেল না। রক্তদানের মঞ্চের পিছনের বহুতলে প্রচার সেরে শশী সিঁড়ি দিয়ে নামতেই উড়ালপুল-বিরোধী, অরাজনৈতিক নাগরিক মঞ্চের প্রতিবাদীরা তাঁর সামনে। পোস্টার বলছে, ‘বন্ধ করো উড়ালপুল নির্মাণ, সঙ্কট মে হ্যায় তন-মন-প্রাণ’! তার সামনে দাঁড়িয়ে শাসক দলের প্রার্থী সোজা ব্যাটে খেলাই শ্রেয় মনে করলেন। প্রতিবাদীরা বলছেন, ‘মানুষের জীবন বিপন্ন করে উড়ালপুল নির্মাণ বন্ধ করা হোক। আমরা উড়ালপুলের বিরোধী!’ শুনে বিদায়ী মন্ত্রীর সটান জবাব, ‘আমিও তো এখানে উড়ালপুলের বিরোধী’!
এটুকু সপ্রতিভতাই অবশ্য শাসক দলের অস্বস্তির কাঁটা দূর করার জন্য যথেষ্ট বলা যাচ্ছে না। বরং প্রশ্ন উঠছে, কই, শশীর মুখে এমন কথা আগে তো শোনা যায়নি? মুখ্যমন্ত্রী যখন তড়িঘড়ি এই উড়ালপুল শেষ করার কথা বলেন, তখন ‘শশী পাঁজা’রাই তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন। ভোটপ্রচারে কলকাতার রাস্তাঘাট-সারাই, পার্কে আলোর সাজ নিয়ে শাসকের যাবতীয় অহঙ্কারের দাবিতে অনেকটাই কালি ছিটোচ্ছে উড়ালপুল-কাণ্ড। উত্তর কলকাতার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটের আগের শেষ রবিবার, বিপর্যয়ের সেই ছায়াটুকুকেই দিনের অন্য সব রং শুষে নিতে দেখা গেল। শশী ও প্রতিবাদীরা যখন পাথুরিয়াঘাটায় মুখোমুখি, ঠিক তখনই অন্য প্রান্তে, নিউ মার্কেট থানার পিছনের কাবাব-পরোটা ও চামড়ার ব্যাগের গলিও উড়ালপুলময়। লাল শালু বাঁধা মঞ্চে তখন আসীন চৌরঙ্গির জোট প্রার্থী, কংগ্রেসের পোড়খাওয়া সোমেন মিত্র। জোটসঙ্গী মহম্মদ সেলিম, অনাদি সাউরা ঝাঁঝালো ভঙ্গিতে নারদ-কাণ্ডের সূত্র ধরে উড়ালপুল থেকে শুরু করে শহরে যাবতীয় নির্মাণ-যজ্ঞে দরপত্রে দুর্নীতি ও গুণমানে আপসের অভিযোগ তুললেন। গোলমেলে টেন্ডারের মন্ত্রী কেন গ্রেফতার হচ্ছেন না, প্রশ্ন তুলে সোমেনবাবু নিজেও হইচই ফেলে দিলেন।
সন্ধ্যায় বেলগাছিয়ায় কংগ্রেসের ডাকা সভায় শাকিল আহমেদের পাশে বসে আবার সরব বেলগাছিয়া-কাশীপুর কেন্দ্রে জোট তথা সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা বসু ঘোষ। দুর্নীতি ও উড়ালপুল-বিপর্যয়ের যোগসূত্র টেনে ধরে তিনি নোট লুঠ ও ভোট লুঠের সরকারকে বিদেয় করার ডাক দিলেন। বাম আমলের মন্ত্রী, এন্টালির প্রার্থী দেবেশ দাসের বিবিবাগানের সভাতেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠল। আর বিকেলে শ্যামপুকুর থানার কাছে জোটের মিছিলে, ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী পিয়ালি সাহা ধুয়ো তুললেন, ‘‘এত দিন রাজ্যে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব নিয়ে আমরা কথা বলতাম। এখন দেখুন কোনও মানুষেরই নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। যে কোনও সময়ে মাথার উপরে ঘোর বিপদ আসতে পারে।’’
মানিকতলায় শাসক দলের হেভিওয়েট সাধন পাণ্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজীব মজুমদারও উড়ালপুল-রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে শাসকের ‘অপদার্থ’তাকেই দিনভর নিশানা করেছেন। কাঁকুড়গাছিতে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ১৩ তলার বহুতল ঢুঁড়ে ফেলতে ফেলতেও বাসিন্দাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন শাসকের ‘ব্যর্থতা’। ভোটের প্রাক্কালে শহরের রবিবাসরীয় অতিথি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রচার-সভাতেও তো সেই উড়ালপুল-কাণ্ডের ছায়া। চৌরঙ্গির বিজেপি প্রার্থী রিতেশ তিওয়ারি, জোড়াসাঁকোর চ্যালেঞ্জার রাহুল সিংহদের পাশে নিয়ে যিনি মমতার জমানার সিন্ডিকেট-রাজ ও উড়ালপুল-বিপর্যয়ের যোগ তুলে ধরলেন। দেখা গেল, বৌবাজারের মোড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্ধ্য সভা খানিক রক্ষণাত্মক মেজাজেই দুর্নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা বিঁধতে চেষ্টা করছে।
পাখি-সখ্য। কলেজ স্ট্রিটে প্রচারে স্মিতা বক্সী ও পথে জুটি। কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটে রাহুল সিংহ ও মীনাদেবী পুরোহিত।ছবি: সুমন বল্লভ ও সুদীপ্ত ভৌমিক
এ হেন পটভূমিতে উড়ালপুলের নাম শুনলে স্বভাবতই মেজাজ বিগড়োচ্ছে জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের তৃণমূলপ্রার্থী স্মিতা বক্সির। বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের গোলমেলে অংশের মালমশলা বা মজুর সরবরাহের নেপথ্যে স্মিতা ও তাঁর স্বামী সঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রজত বক্সীর নাম উঠে এসেছে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে। প্রধানমন্ত্রী-কথিত সিন্ডিকেট-সংস্কৃতির অভিযোগ অতএব কাঁটার মতো স্মিতার পায়েই এসে বিঁধছে বৈকী! এর মধ্যে জোড়াসাঁকোর প্রার্থীকে ভোগাচ্ছে তাঁর বাঁ পায়ের ব্যথাও। সেটাও উড়ালপুল-কাণ্ডের পরিণাম, বলা যায়। ‘‘সে দিন তড়িঘড়ি স্পটে যেতে গিয়েই পা মচকে এই দশা আমার!’’ সকাল ৯টা নাগাদ কলেজ স্ট্রিটে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের অফিসের সামনে ম-স্ত প্লাস্টার পায়ে প্রচারের অটোয় উঠতে উঠতে সে কথাই বললেন স্মিতা।
তা বলে অবশ্য শেষ রবিবার স্লগ ওভারের প্রচারে ফাঁকি নেই। সকালে মেডিক্যাল কলেজ চত্বর, দুপুরে সত্যনারায়ণ পার্ক, বিকেলে ব্রেবোর্ন রোড, সন্ধ্যায় চালতাবাগান— রোড-শো, সভা, দরজায়-দরজায় প্রচার চলছেই। এক ফাঁকে স্মিতা বললেন, ‘‘এই পা নিয়েই কিন্তু বস্তির ভিতরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি বাড়ি ঘুরছি।’’ বিরোধীরাও শাসকের দুর্নীতির খবর একই ভাবে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।
আর মোটে দু’দিন বাকি প্রচারের! উড়ালপুল-উন্নয়নের জাঁতাকলে জেরবার ভোটগ্রস্ত সাবেক শহর, এমনই টানাপড়েনময়।