প্রশান্ত কিশোর। —ফাইল চিত্র।
এতটা ভাল ফল আশা করেননি তিনি নিজেও। ভোটগণনার সন্ধ্যায় সে কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয় বার রাজ্যের শাসনভার হাতে পেয়ে তাই বাংলার মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রকাশ্যে যাঁর নাম উল্লেখ করলেন না মমতা, তিনি যদিও ভোটের ময়দানে ছিলেন না। কিন্তু তৃণমূলনেত্রীকে আক্রমণ করতে গিয়ে বার বার তাঁর নামই উঠে এসেছে বিজেপি নেতৃত্বের মুখে। তিনি তৃণমূলের এই অভাবনীয় সাফল্যের নেপথ্য কারিগর প্রশান্ত কিশোর (পিকে)।
পারিশ্রমিক নিয়ে তৃণমূলের ভিত মজবুত করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে তৃণমূলকে জেতানোটা কোথাও যেন পিকে-র ব্যক্তিগত আদর্শের লড়াই হয়ে ওঠে। যে কারণে ভোটের ফলাফল সামনে আসার পর অকপটে তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘‘টাকা ফেলে আমাদের কাজ করানোর ক্ষমতা নেই কারও। কার সঙ্গে কাজ করব, সেটা আমরা নিজেরা ঠিক করি।’’
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর রাজ্যে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছিল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহরা ঘন ঘন বঙ্গসফরে আসতে শুরু করেন। সেই সময় তৃণমূলের অতি বড় শুভাকাঙ্ক্ষীও দু’শো আসন পেরনোর স্বপ্ন দেখার সাহস পাননি। তৃণমূল ঠিক ক’টি আসনে জয়ী হবে, তার কোনও হিসেবনিকেশ যদিও প্রকাশ করেননি প্রশান্ত। কিন্তু বিজেপি যে ভোটবাক্সে দুই সংখ্যাও পেরোবে না, সে কথা বার বার বলেছেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বার বার ‘অব কি বার দো’শো পার’ ধ্বনি দিয়ে হাওয়া গরম করলেও, প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রশান্ত বলে গিয়েছেন, ভোটবাক্সে বিজেপি তিন অংঙ্কের সংখ্যা পেরোলে ভোটকুশলীর পেশা ছেড়ে দেবেন তিনি। তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি তাঁকে। কিন্তু রবিবার প্রশান্তের কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে। তিন অঙ্কে পৌঁছনো তো দূর, অনেক আগেই থেমে যেতে হয়েছে বিজেপি-কে।
নীল বাড়ির লড়াইয়ের ফল নতুন করে ফের প্রশান্তকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে রবিবার। কোনও রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য না হয়েও কী ভাবে বাংলার নাড়ি-নক্ষত্র বুঝে গেলেন তিনি, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তবে বাংলায় তৃণমূলকে সর্বকালীন বড় জয় এনে দিলেও, ২০২১-এর নীলবাড়ির লড়াই প্রশান্তের মুকুটে একটি বাড়তি পালক। এর আগে, ২০১২-য় গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীকে তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত মোদী ঢেউয়ের তরঙ্গ পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্যেও ছিল প্রশান্তরই মস্তিষ্ক। ২০১৫-য় লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দলের জোট গড়ার পিছনেও ছিল তাঁর মাথা। ২০১৭-র পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া থেকে ২০২০-তে দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীবালের বিপুল জয়ের নীল নকশাও তাঁর তৈরি। এমনকি রবিবার মমতার পাশাপাশি তামিলনাড়ুতে এমকে স্ট্যালিনকেও জয় এনে দিয়েছেন তিনি।
ভোটের রণকৌশলকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেওয়ার আগে দীর্ঘ ৮ বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রশান্ত। বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাস্থ্য এবং দারিদ্র ঘোচানোর অভিযানে যুক্ত থেকেছেন। কাছ থেকে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই দেখার সুযোগ পেয়েছেন বলেই, ভারতের মতো দেশ, যেখানে একটা বড় অংশের মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে, তাঁদের চাহিদা তিনি ভাল ভাবে বুঝতে পেরেছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে প্রশান্তের এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ভোটবাক্স ভরতে আগ্রহী হয়েছেন রাজনীতিকরা। তাঁদের দাবি, বিহারে মহিলাদের সমর্থন পেতে মদ নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নীতীশ, সেটাই তাঁর ক্ষমতায় আসার রাস্তা আরও প্রশস্ত করেছিল। এর নেপথ্যেও প্রশান্তের ভূমিকা ছিল। একই ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী’, ‘দুয়ারে সরকার’ এবং তৃণমূলের ‘দিদিকে বলো’র মতো জনদরদি এবং জন কল্যাণমূলক প্রকল্পের নেপথ্যেও তাঁর ভূমিকা খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
তবে এ সবের বাইরেও মমতা এবং প্রশান্তের মধ্যে একটা আদর্শগত মিল খুঁজে পেয়েছেন ভোট বিশ্লেষকদের একাংশ। বিহারে নীতীশ বিজেপি-র হাত ধরার পরেও সংযুক্ত জনতা দলের সহ-সভাপতির পদে ছিলেন প্রশান্ত। কিন্তু সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি ((এনপিআর)-র কার্যকর করতে বিজেপি যখন উঠেপড়ে লেগেছে এবং জোটসঙ্গীর এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না নীতীশ, সেই সময় তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছিলেন প্রশান্ত। সেই সময় বাংলায় সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআর-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন মমতাও। এই প্রতিবাদই তাঁদের একসুতোয় বেঁধে দিয়েছিল মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
কিন্তু রবিবার তৃণমূলের হাতে সবচেয়ে বড় সাফল্যটি তুলে দেওয়ার পর আশ্চর্য এক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন প্রশান্ত। জানিয়েছেন, ভোটকুশলীর পেশা ছাড়ছেন তিনি। জীবনে এ বার অন্য কিছু করার কথা ভাবছেন। তা হলে কি এ বার নিজেই সক্রিয় রাজনীতিতে আসার কথা ভাবছেন প্রশান্ত? জল্পনায় খামতি নেই। তবে ধোঁয়াশা জিইয়ে রেখেছেন প্রশান্ত।