মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হরিশ মুখার্জি রোডের ‘শান্তিনিকেতন’ নয়। ৯ নম্বর ক্যামাক স্ট্রিটও নয়। তৃণমূলের রাশ এখনও ধরা রয়েছে ৩০ বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দার হাতেই। শুক্রবার দুপুরে সেই ঠিকানা থেকে ঘোষিত রাজ্যের শাসকদলের প্রার্থিতালিকা তেমনই দেখিয়ে দিল। দেখিয়ে দিল, দলের উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নিরঙ্কুশ’ প্রাধান্য এবং কর্তৃত্ব এখনও অটুট। দেখিয়ে দিল, মমতার হাতে দলের রাশ যতটা রয়েছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বা ভোট-কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের হাতে ততটা নেই। ভোটের প্রার্থী ঘোষণার আগে তৃণমূলের অন্দরে এমন জল্পনা ঘুরছিল যে, প্রার্থী বাছাইয়ে শেষকথা বলবেন অভিষেক-প্রশান্ত জুটিই। কিন্তু যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে মমতার ‘হাতযশ’ই প্রধান। এটা ঠিক যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিষেক-প্রশান্ত জুটির সুপারিশ মানা হয়েছে। কয়েকজন বিধায়ককে আবার মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের মতামত প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু প্রাধান্য থেকে গিয়েছে দলের সর্বময় নেত্রীরই।
তৃণমূলের নেতাদের একাংশ জানাচ্ছেন, শুক্রবার ঘোষিত প্রাথিতালিকার ছত্রে ছত্রে রয়েছে মমতার অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দৃষ্টি এবং বিভিন্ন সমীকরণ। কঠিন হাতে মমতা প্রার্থিতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ সোনালী গুহ, মালা সাহা, স্মিতা বক্সীদের। তেমনই ভাইপো অভিষেকের ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে অভিজ্ঞ নেতাদেরই টিকিট দিয়েছেন। কারণ, তিনি সম্যক বুঝেছেন, ডায়মন্ড হারবারের বিধায়ক দীপক হালদার বিজেপি-তে যোগ দেওয়ায় পুরোনো দিনের কর্মীরা বিমুখ হতে পারেন। তাই নয়ের দশক থেকে তাঁর সঙ্গে থাকা পান্নালাল হালদারকে ডায়মন্ড হারবার বিধানসভায় প্রার্থী করেছেন মমতা। সাতগাছিয়ায় সোনালির বদলে প্রার্থী করেছেন পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি মোহন নস্করকে। অনেক জল্পনা থাকলেও প্রার্থী করা হয়েছে প্রবীণ বিধায়ক অশোক দেবকে। যাঁকে এবার প্রার্থী করা হবে না বলেই ধরে নিয়েছিলেন তৃণমূল শিবিরের অনেকে।
বস্তুত, দলের বেশ কয়েকজন বিধায়ক প্রশান্তর কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন তাঁদের আসন বদলে দেওয়ার জন্য। চেয়েছিলেন কলকাতার কাছাকাছি আসনে প্রার্থী হতে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, তাতে কান দেননি দলনেত্রী। সটান বলেছেন, দাঁড়াতে হলে পুরোন আসনেই দাঁড়াতে হবে। সে গ্রামীণ আসন হলেও। যে উদাহরণ দেখিয়ে তৃণমূলের এক প্রথমসারির নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী বলছেন, ‘‘অনেকেই ভেবেছিল অভিষেকের কাছে দরবার করে নিজের পছন্দসই আসনটা বাগিয়ে নেবে। অনেকে প্রার্থী হওয়ার জন্যও সেখানে রাতদিন দরবার করেছে। কিন্তু মমতা’দি সে সব আবেদন ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। তিনি সকলের সমস্ত মতামতই শুনেছেন। পরামর্শও শুনেছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজের অভিজ্ঞতা এবং বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রার্থী বাছাই করেছেন। রাজ্যের এক মন্ত্রী এবং দুই আমলা শেষ দিন পর্যন্ত উমেদারি করে গিয়েছেন টিকিটের জন্য। কিন্তু মমতা কর্ণপাতও করেননি।
ফলতা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা এলাকার ‘দাপুটে যুবনেতা’ জাহাঙ্গির খানের ফলতা আসনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে জোর জল্পনা ছিল। কিন্তু সেখানেও ‘অভিজ্ঞতা এবং বিচক্ষণতা’ দেখিয়ে শঙ্কর কুমার নস্করকে প্রার্থী করে মোক্ষম চাল দিয়েছেন মমতা। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই প্রান্তে আব্বাস সিদ্দিকির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাই কোনও সংখ্যালঘু প্রার্থী না দিয়ে উল্টে হিন্দু প্রার্থী দিয়ে ফলতা আসনটি ধরে রাখতে চেয়েছেন তিনি। আবার পাশাপাশিই, উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রামে বিধায়ক জেমস কুজুরকে সরিয়ে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন লেওস কুজুর। যে লেওস একদা চা-বাগান এলাকার বিজেপি-র নেতা ছিলেন। মাস দুয়েক আগেই তিনি দল বদল করে তৃণমূলে এসেছেন। বিজেপি-কে ধাক্কা দিতে লেওসকেই ‘অস্ত্র’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন মমতা।
‘অধিকারী গড়’ দক্ষিণ কাঁথিতে শিশির-শুভেন্দু-দিব্যেন্দু-সৌম্যেন্দুদের চ্যালেঞ্জ জানাতে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই ভরসা করেছেন মমতা। পটাশপুরের দু’বারের বিধায়ক জ্যোতির্ময় করকে নিয়ে আসা হয়েছে দক্ষিণ কাঁথি আসনে। আবার এই ‘কঠিন সময়ে’ সবং আসনের বর্তমান বিধায়ক গীতা ভুঁইয়াকে সরিয়ে তাঁর স্বামী তথা ভোটে লড়তে অভিজ্ঞ মানস ভুঁইয়ার উপর আস্থা রেখেছেন তৃণমূলনেত্রী। সবংয়ে ছ’বার বিজয়ী রাজ্যসভার সাংসদ মানসকে আবার সবংয়ে ফিরিয়ে এনেছেন মমতা। চণ্ডীপুরের বিধায়ক অমিয়কান্তি ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্তরে একাধিক অভিযোগ উঠেছিল। তাই তাঁকে বাদ দিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে পরিচ্ছন্ন ভামূর্তির অভিনেতা সোহম চক্রবর্তীকে। গত লোকসভা ভোটে বাঁকুড়া লোকসভার একটি আসনেও ‘লিড’ পায়নি তৃণমূল। তাই বাঁকুড়া বিধানসভায় জয় পেতে অভিনেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর আস্থা রেখেছেন মমতা। কৃষ্ণনগর লোকসভা আসনটি জিতলেও কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভায় ৫৫,০০০ ভোটে পিছিয়েছিল তৃণমূল। সেই আসনে জোড়াফুল ফোটাতে অভিনেত্রী কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের গ্ল্যামারের ওপর ভরসা করেছেন মমতা। একইভাবে উত্তরপাড়া দখলে আনতে বাংলা ছবির পরিচিত মুখ কৌতুকাভিনেতা কাঞ্চন মল্লিককে ‘তুরুপের তাস’ করেছেন মমতা। একই কারণে ব্যারাকপুরে রাজ চক্রবর্তীকে প্রার্থী করা হয়েছে।
হাওড়া জেলায় শিবপুর আসনে প্রভাবশালী বিধায়ক জটু লাহিড়ি বাদ পড়েছেন বয়সজনিত কারণে। তাঁর ‘প্রভাব’ কাটাতে প্রাক্তন ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারিকে শিবপুরে প্রার্থী করেছেন মমতা। চারবারের বিধায়ক শীতল সর্দারকে সরিয়ে মহিলানেত্রী পিয়া পালকে প্রার্থী করেছেন হাওড়ার সাঁকরাইলে। উলুবেড়িয়া পূর্ব আসনটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হলেও সম্প্রতি বিজেপি প্রভাব বাড়িয়েছে সেখানে। তাই বিধায়ক ইদ্রিশ আলিকে সেই আসন থেকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে প্রাক্তন ফুটবলার বিদেশ বসুকে। হুগলি জেলার তারকেশ্বর আসনে অসুস্থ প্রাক্তন আইপিএস রচপাল সিংহকে সরিয়ে দিয়ে বহুদিনে দাবি মেনে এক ভুমিপুত্র রামেন্দু সিংহরায়কে প্রার্থী করা হয়েছে। বস্তুত, বিজেপি যাতে তাঁর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ‘সংখ্যালঘু নির্ভরতা’-র অভিযোগ না তুলতে পারে, সেই বিষয়েও খেয়াল রেখেছেন তৃণমূলনেত্রী। ২০১৬ সালে তৃণমূলের তালিকায় ৫৬ জন সংখ্যালঘু প্রার্থী ছিলেন। এবার ৪৩।