প্রতীকী ছবি।
পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত, ৬৭ বছরের সমর মিত্রের চলাফেরা ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই ইচ্ছে থাকলেও গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে যেতে পারেননি তিনি। কারণ, তাঁর বুথ পড়ে দোতলায়। একই কারণে কোনও দিন ভোট দিতে যাওয়া হয়নি মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে আক্রান্ত বছর পঁচিশের মানসীরও।
তবে এ বার ভোট দেবেন ওঁরা। কারণ, ওঁদের কথা ভেবেই এ বারই প্রথম সব বুথ হবে একতলায়। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে এই পরিবর্তনকে বড় জয় হিসেবে দেখছে মানসিক, শারীরিক এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ভোটদাতাদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসা সংগঠনগুলি।
বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ভোটদাতাদের উৎসাহিত করতে এ বারের ভোটে আরও কিছু পরিবর্তন করা হচ্ছে। যেমন, প্রয়োজন বুঝে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে থাকবে হুইলচেয়ার। কোথাও আবার থাকবেন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার। এ ছাড়া ব্রেল-ব্যালট ব্যবস্থা তো অন্যান্য বছরের মতো আছেই। এই সব সুবিধা যথাযথ ভাবে যাতে উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তার বিশেষ প্রশিক্ষণ হবে। উত্তর কলকাতার অধীনে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের বুথকর্মীদের সেই প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, যেখানে মানসিক এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজ়এবিলিটি নিয়ে কাজ করা সংগঠনের প্রধানদেরও থাকার কথা। কারণ, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজ়এবিলিটি বাইরে থেকে বোঝা যায় না। অথচ রাইফেলধারী নিরাপত্তাকর্মী দেখলে ওঁদের অনেকেই ভয় পেয়ে যান। কেউ বেশি লোকজন দেখলে কিংবা জোরে কথা বললে অস্বস্তি বোধ করেন। যে কারণে এমন পরিস্থিতিতে কী ভাবে ওঁদের শান্ত রাখতে হবে, প্রশিক্ষণে তারও পথ বলে দেওয়া হবে ওই কর্মীদের।
উত্তর কলকাতা জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রের খবর, ডিস্ট্রিক্ট মনিটরিং কমিটি গঠন হয়ে গিয়েছে। ‘ডিস্ট্রিক্ট আইকন’ নির্বাচিত হয়েছেন কাঞ্চন গাবা। ২০১৯ সালেও তিনি ‘আইকন’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে দু’চোখের দৃষ্টি হারিয়েও পেশায় আইনজীবী-শিক্ষক তিনি। পেশায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার ও পর্বতারোহী হিসেবে পরিচিত কাঞ্চন বলেন, “ভোটদানে সকলের অংশগ্রহণের বার্তা দিতে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যাব। এ ছাড়াও যে ভাবে অফিস থেকে নির্দেশ আসবে, সে ভাবেই পাশে থাকব।”
‘সিস্টেমেটিক ভোটার্স এডুকেশন অ্যান্ড ইলেক্টোরাল পার্টিসিপেশন (এসভিইইপি), উত্তর কলকাতার’ দায়িত্বে থাকা আধিকারিক সাজ়িয়া সাগুফতা জানান, সব ধরনের এবং সব বয়সি ভোটারদের উৎসাহিত করতে কাঞ্চনকে নিয়ে একাধিক পদক্ষেপ করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “পিডব্লিউডি (পার্সন্স উইথ ডিজ়এবিলিটি) ভোটদাতাদের ফোন নম্বর নিয়ে তালিকা তৈরি হচ্ছে। যাতে প্রতিবন্ধী ভোটারদের কাছে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের জরুরি বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। ভোটকেন্দ্রে কী কী সুবিধা থাকবে, তাও জানানো হবে মোবাইলে।”
দক্ষিণ কলকাতা জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রের খবর, তাদের অধীনে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের পিডব্লিউডি তালিকা সম্পূর্ণ হয়েছে। বর্তমানে ওই সংখ্যা ১৪০০। শেষ নির্বাচনে ওই সংখ্যা ছিল ১১০০।
যাঁরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন না, তাঁদের জন্য থাকছে ই-ব্যালটের ব্যবস্থা। তবে সে জন্য প্রতিবন্ধী কার্ড থাকা আবশ্যিক। মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায় বলেন, “নির্বাচন কমিশনের এই প্রচেষ্টা ইতিবাচক। মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ওঁদের মতামতেরও যে গুরুত্ব আছে, তা বুঝে এই পদক্ষেপ করাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে এখনও অনেকেই প্রতিবন্ধী কার্ড পাননি, তাঁদের মতামতের কী হবে? এই কার্ড না-পাওয়া প্রশাসনিক ব্যর্থতা।” জয়নগর থানা এলাকার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কোঅর্ডিনেটর অরূপকুমার মান্না বলেন, “আমার এলাকায় প্রতিবন্ধী কার্ড না-থাকার সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। এঁরা অনেকেই কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন না।” জেলা প্রতিবন্ধী অফিসের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, করোনার জন্য সব কাজেই স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়েছে। এখন সামনে ভোট থাকায় এত দ্রুত ওই কার্ডের কাজ করা অসম্ভব।
নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজ়এবিলিটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এই ভোটদাতাদের সচেতন করতে ছবি-সহ বার্তা দেওয়া ও কী ভাবে ভোট দিতে হবে, তা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে টেলিভিশনে প্রচার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভিড়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে ওঁদের যাতে অসুবিধা না হয়, তাই বুথগুলিতে আমাদের তরফে গ্রিন চ্যানেল করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।” জেলা নির্বাচন দফতর সূত্রের খবর, এই তিনটি প্রস্তাব এখনও বিবেচনাধীন।