—প্রতীকী চিত্র।
এক মাসের মাথায় ভোট রাজ্যে। তার আগে পূর্ব মেদিনীপুর নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না তৃণমূলের। দলত্যাগী শুভেন্দু অধিকারী যেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনই মাত্র ৩ বছরে রকেট গতিতে বিজেপি-র উত্থানও ভাবাচ্ছে তাদের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়াতে চান বলে হইচই ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুরে চাপের মুখে দাঁড়িয়েই তৃমণূলকে লড়াই করতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচন থেকে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন, এই ৩ বছরে পূর্ব মেদিনীপুরে বিজেপি-র ভোটবাক্স ফুলেফেঁপে উঠেছে। ২০১৬-য় যেখানে ১.৯৬ লক্ষ ভোট পেয়েছিল তারা, ২০১৯-এ তা ১৩ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ ৩ বছরের ব্যবধানে ১১ লক্ষের বেশি ভোট বাড়িয়েছে বিজেপি।
পূর্ব মেদিনীপুরে পদ্ম ফুটিয়ে ছাড়বেন বলে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রামে মমতা প্রার্থী হলে, তাঁকে কমপক্ষে ৫০ হাজার ভোটে হারাবেন বলে আত্মবিশ্বাসী তিনি। শনিবার মেচেদায় ইস্কন মন্দিরেও একই সুর ধরা পড়ে তাঁর গলায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘সারা বছর যে ছাত্র পড়াশুনা করে, তাকে কে হারাবে পরীক্ষায়?’’ লড়াইয়ের মাঠে দেখা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
তবে শুভেন্দুর এই আত্মবিশ্বাসকে হালকা ভাবে নিতে রাজি নন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাঁদের দাবি, শুভেন্দুর এই আত্মতুষ্টির কারন হল, কয়েক বছরে জেলা জুড়ে বিজেপি-র অভাবনীয় উত্থান। এক সময় বামদুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল যে পূর্ব মেদিনীপুর, এখন তাদের প্রতি মোহ কেটে গিয়েছে সাধারণ মানুষের। বরং বাম শিবির থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ গিয়ে ভিড়েছেন গেরুয়া শিবিরে। যে কারণে ২০১৬-য় পূর্ব মেদিনীপুরে ১২.৯১ লক্ষ ভোট পেলেও, ২০১৯-এ তা কমে ২ লক্ষ ৩৩ হাজারে এসে ঠেকে।
এই পরিস্থিতি থেকে বামেদের ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের যুক্তি, গত কয়েক বছরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বামেদের কোনও নজরকাড়া কর্মসূচি ছিল না। পুরনো ভোটারদের ফিরিয়ে আনা, বা নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করার মতো যোগ্য নেতৃত্বও নেই দলে। তাই ব্রিগেড দাপিয়ে বেড়ালেও, পূর্ব মেদিনীপুরে তাঁদের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা ক্ষীণ।
একই ভাবে, শাসক শিবির তৃণমূলেরও প্রায় একই অবস্থা। আমপানের ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, দলে ভাঙন-সহ একাধিক সমস্যায় জর্জরিত তারা। নন্দীগ্রাম, উত্তর কাঁথিতে গত বার জয়ী হওয়া শুভেন্দু অধিকারী এবং বনশ্রী মাইতি সরে গিয়েছেন। এগরার বিধায়ক সমরেশ দাস প্রয়াত। দক্ষিণ কাঁথি এবং মহিষাদল বিধানসভার দুই প্রার্থী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ও সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে, তাঁদের সরানোর দাবি উঠছে।
হলদিয়া, তমলুক এবং পূর্ব পাঁশকুড়ায় গতবারই হেরেছিল তৃণমূল। বাকি ৮টি বিধানসভা কেন্দ্র, পশ্চিম পাঁশকুড়া, ময়না, নন্দকুমার, চণ্ডীপুর, ভগবানপুর, খেজুরি, রামনগর এবং পটাশপুর বিধানসভায় গত বার জয়ী হলেও, সে বার যদিও ভোটের বৈতরণী পার করে দিয়েছিলেন শুভেন্দু। এ বার তিনি গেরুয়া শিবিরে। এমন পরিস্থিতিতে শাসক দলকে কড়া টক্করের মুখে পড়তে হবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
জেলার তৃণমূল নেতা মামুদ হোসেন যদিও এই দাবি উড়িয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ লোকসভা আর বিধানসভা এক নয়। তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর নানান জনমুখী প্রকল্পে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মানুষ উপকৃত। সেখানে কেন্দ্রের ভ্রান্ত নীতির জন্য জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছোঁয়া, রান্নার গ্যাসে চুপিসাড়ে ভর্তুকি তুলে নেওয়া এবং দাম বাড়ানোয় নাভিশ্বাস উঠছে মানুষের।’’ তাই এ বারের বিধানসভায় মানুষ বিজেপি-কে যোগ্য জবাব দেবেন বলেই মনে করছেন তিনি।
জমি আন্দোলনের পর নন্দীগ্রামে লক্ষ্মণ শেঠের ডানা ছেঁটে দিয়েছিল সিপিএম। তার জেরে লক্ষ্মণের অনুগামীরাও দল ছেড়ে দেন। এর ফলে রাতারাতি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন সেখানকার বাম সমর্থকরা। এর পরেও ২০১৬ সালে সমর্থকরা দলের প্রতি আনুগত্য দেখালেও, জেলাজুড়ে আন্দোলনে ছাপ ফেলতে ব্যর্থ বাম নেতৃত্ব। ২০১৯-এ তাই বিপুল সংখ্যক ভোটার বিজেপি-তে চলে যান। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে এখনও তেমন কোনও পদক্ষেপ করতে পারেননি বাম নেতৃত্ব। এমনকি ভোট ঘোষণার ঢের আগে থেকে তৃণমূল এবং বিজেপি যেখানে জেলা চষে বেড়াচ্ছেন, সেখানে দু’-একটি কর্মসূচি ছাড়া বামেদের কোনও গতিবিধি নজর কাড়তে পারেনি।
’২১-এর নির্বাচনের কৌশল নিয়ে জানতে চাইলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সিপিএম-এর সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন, ‘‘দলের সমস্ত শাখার নেতারাই মাঠে নেমে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে জেলায় কয়েকটি সভা হয়েছে। সেখানে সমর্থকদের ভিড়ও যথেষ্ট ছিল। তবে এবার ভোটারদের বাড়ি বাড়ি প্রচারেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।’’ তাঁর আশা, বাম আন্দোলনে আজও আস্থা রয়েছে মানুষের।