প্রচারে এক খুদের সঙ্গে রুদ্রনীল ঘোষ। নিজস্ব চিত্র
একই অঙ্গে ক-ত রূপ!
চিড়িয়াখানার হাতিদের উঠোন লাগোয়া রাজপথ অরফ্যানগঞ্জে তাঁর স্পন্দিত বক্ষে ‘জনদরদী’, কোকেন-কাণ্ড খ্যাত রাকেশ সিংহের ‘বসত’। কিন্তু রুদ্রনীল ঘোষের হৃদয়ে এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাকেশের এলাকায় রুদ্র ও রাকেশের নামে একযোগে জিন্দাবাদ ধ্বনি। রাকেশের বৃদ্ধ বাবাকে ভক্তিভরে প্রণাম-পর্বের সময়ে রুদ্র বলছিলেন, “ওই রকম অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধেই থাকে। রাকেশের নামে অভিযোগ তো প্রমাণ হয়নি। সবার বুকে বুকে জননেতা রাকেশ রয়েছেন।”
দুপুরে খাস ভবানীপুরে ওই বিধানসভা কেন্দ্রের নতুন কার্যালয়ে বিজেপি প্রার্থী, সু-অভিনেতা অকপট তাঁর মমতা-প্রশস্তিতে। “ওঁর রাজনীতি থেকে আমি সরে এসেছি, কিন্তু ওই অক্লান্ত পরিশ্রম মনে আছে। আমি রাজনীতি-সচেতন ছেলে! ২০১৪ বা ’১৬-র ভোটপ্রচারে ওঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি।” রুদ্রের কথায়, “খুব সাধারণ থেকে শীর্ষে ওঠা বাঙালির তালিকায় আমার তিন জন স্ট্রাগল আইকন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রসেনজিৎ।” মুখ্যমন্ত্রীর পুরনো কেন্দ্রে ভোটপ্রচারে বেরিয়ে তবু সগর্জনে ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায় না’ বলছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী এখানে বিদায়ী বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাই সিইএসসি-র বিদ্যুতের চড়া মাসুল, আমপানের পরে সিইএসসি-কে ‘রক্ষা’ করতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টুইট— রুদ্র তা-ও মনে করাচ্ছেন।
নেট-রাজ্যে ঘুরপাক খাওয়া মিমে রুদ্রলাল, রুদ্রসবুজ, রুদ্রগেরুয়া অবতার নিয়ে হাসাহাসি। তাঁর ভাইরাল সংলাপ, ‘সেটা বড় কথা নয়’ বা ‘সাতে-পাঁচে থাকি না’রও রকমারি প্যারোডি। একদা সিপিএমের পার্টি মেম্বার থেকে মমতার আমলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা পর্ষদ, ‘রাইট টু পাবলিক সার্ভিস কমিশন’-এ মোটা মাইনের পদ অলঙ্কৃত করার পরে ভোটের ঠিক আগে বিজেপি-ভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ভোটে এর প্রভাব পড়বে না বলে তিনি নিঃসংশয়। তাঁর নতুন কৌতুক ভিডিয়োয় সবুজ আমটি ফেলে কমলালেবুর হয়ে সওয়াল করার ভঙ্গিতেই বলছিলেন, “তৃণমূল আমলে বেকারত্ব, দুর্নীতি। আমি গিরগিটি হলে মানুষও গিরগিটি!”
টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে একার সংসারে ফিরতে এখন আকছার রাত দেড়টা, দু’টো বাজে। তাই ভবানীপুরের একটি সাবেক বাড়িকে পাল্টে তৈরি হওয়া বিধানসভা কার্যালয়ে প্রার্থীর ঘরে সোফা জুড়ে চিলতে এসি বিশ্রামাগার। দুপুরে প্রচার সেরে তিনি তেতলার ঘরে ঢোকার আগেই ঘনিষ্ঠ কর্মীদের গুঞ্জন, রুদ্রদা কী করছে বল তো! কালও ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুমিয়েছে! কমিশনের নয়া নির্দেশে বেলা দশটার আগে এখন প্রচার নেই। অরফ্যানগঞ্জে চড়া রোদে অপেক্ষমাণ কর্মীদের সামনে রুদ্রর অবতীর্ণ হতে তবু বেলা সাড়ে ১১টা। বিকেল সাড়ে তিনটে অবধি মধ্যপ্রদেশের নেত্রী-কাম-মন্ত্রী অর্চনা চিটনিসের সঙ্গে মিটিংয়ের পরে চান-খাওয়ার ছুটি মিলল। মাছ-ভাত খেয়ে এসিতে গায়ে কম্বল টেনে রুদ্র বলছেন, “টেনশনে নেই! তবে ঘুমটা হচ্ছে না! পুলিশ পুরো তৃণমূল এখানে। তৃণমূল মারতে আসছে। পুলিশ আমাদেরই ভুলভাল কেস দিচ্ছে।”
টালিগঞ্জে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজ, কাঞ্চন তৃণমূলের প্রার্থী। পরমব্রত বিজেপি-বিরোধী অবস্থানে সরব। এই বিষয়গুলি ব্যক্তি পরিসরে বড় নয় বলে দাবি করেও পরমদের গান ‘আমি এই দেশেতেই থাকব’ নিয়ে রুদ্রের রাগটা প্রকট। দিলীপ ঘোষের ‘রগড়ানি’ হুমকিকে কার্যত সমর্থন করেই রুদ্র বলছেন, “কে পরমদের পাকিস্তানে যেতে বলল!” তাঁর হয়ে প্রচারে আসা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধেই নন্দীগ্রামে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের প্রচার-অভিযোগ রয়েছে। শুনে রুদ্র বলছেন, “সকালের মিছিলে ‘সোনার বাংলার সোনার ছেলে রুদ্রনীল’ বলছিল যে মেয়েটি, সে ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিম নেত্রী!”
আলিপুরের মহিলা মোর্চা নেত্রী পারমিতা দত্ত গদগদ, “রুদ্রদার ‘দত্তবাবু’ ভিডিয়োটা কিন্তু মারোয়াড়িরাও দেখেছেন।” তবে রুদ্র জানেন, ৬০ শতাংশ অ-বাংলাভাষীর কেন্দ্রে মোদী-অমিত শাহের প্রার্থী পরিচিতিটাই বড় ভরসা। প্রচারের প্রথম এক ঘণ্টায় তাই আধ কিলোমিটার পথে ৩০-৩৫ মিনিট জনৈক দলীয় কার্যকর্তা, একটি গোঁড়া সমর্থক পরিবার এবং বাঁকেবিহারী মন্দিরে সময় দিলেন। তিন বার লস্যি, ঘোল, আমপান্নার স্কোয়াশ পান। দু’জন ব্যক্তিগত সহকারী অনর্গল ছবি তুলছেন। ছোট্টখাট্টো প্রার্থীকে দীর্ঘদেহী প্রৌঢ়ের হাল্কা আদর, ‘জিতকে আইয়ে, আপ কো ছে ফুট বনা দুঙ্গা’! ভোট মিটলেই রুদ্র অজয় দেবগনের সঙ্গে হিন্দি ছবির শুটিং শেষ করতে যাবেন। তিনি আশাবাদী, হিন্দু রাষ্ট্র-টাষ্ট্র নয়, নানা অপ্রাপ্তির ক্ষোভ আর দলের রণকৌশলই নাকি অবধারিত ভাবে ভবানীপুরে পদ্ম ফোটাবে।