প্রতীকী ছবি। ফাইল চিত্র
পাঁচ বছরের ছেলে অমিয়কে সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে বসিয়ে গানের সুর তুলে ভুতনি সেতু পার হচ্ছিলেন খোসবরটোলার সনাতন মণ্ডল। দু’বছর আগে এ ভাবে গান গাইতে গাইতে ফুলহর নদী পেরোতে পারতেন? গান থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন সনাতন।
একসময় ধুধু বালি চরে ঘাম ঝরিয়ে সাইকেল ঠেঙিয়ে, সময়ে বাঁধা নৌকায় খেয়া চড়ে ফুলহর পার হতে হত সনাতনদের। একই ভাবে গঙ্গার ভাঙনে এক সময় রাতের ঘুম উড়ে যেত ভুতনির চরের লক্ষাধিক বাসিনিদার। কিন্তু ভাঙনের সেই ভয়াবহতা থমকেছে মানিকচক বিধানসভা জুড়ে। কিন্তু এই সেতু তৈরির মত উন্নয়ন বা ভাঙন রোখার কৃতিত্ব নিয়ে মানিকচকের রাজনীতি এখন তোলপাড়।
ধর্মের চোরাস্রোত ও ভোট ভাগাভাগির জটিল অঙ্কও রয়েছে জনপদের ভোট চর্চায়। ভয়ঙ্কর ভাঙনের সেই কলরব এখন অনেকটাই স্তিমিত গঙ্গাপাড়ের আরেক জনপদ মোথাবাড়ি বিধানসভাতেও। সেই কৃতিত্ব নিয়েও তরজার মাঝে আবার ধর্মের চোরাবালি এবং সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগির অঙ্কও আবর্তিত হচ্ছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জনপদেও।
প্রায় ১৩২ কোটি টাকা খরচে তৈরি মানিকচকের ভুতনি সেতু চালু হয়েছে এক বছর আগে। কিন্তু উন্নয়নের এই ফল্গুধারা আদতে কি ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে? গত বিধানসভা ভোটের আগেই এই সেতু তৈরির কাজ শুরু করার কৃতিত্বকে ঢাল করে ভোট প্রচার করেছিলেন তৃণমূল প্রার্থী সাবিত্রী মিত্র। কিন্তু দেখা দেখা যায়, প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে জোট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মোত্তাকিন আলমের কাছে হেরে যান সাবিত্রী। গত লোকসভায় এখানে তৃণমূলের চেয়ে বিজেপি লিড পায় ৩৪ হাজার আর কংগ্রেসের চেয়ে ২৯ হাজার ভোটে।
তবে উন্নয়নকে বাজি রেখে এবারও প্রচারে ঝাঁপিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী সাবিত্রী মিত্র। তাঁর কথায়, ‘‘গত ১০ বছরে তৃণমূল সরকারের আমলে মানিকচক বিধানসভায় যা উন্নয়ন হয়েছে তা কষ্মিনকালেও হয়নি।’’ এবারেও কংগ্রেস প্রার্থী মোত্তাকিন আলম। আর একসময়ে সাবিত্রীর সঙ্গেই থাকা মালদহ জেলা পরিষদের সভাধিপতি গৌরচন্দ্র মণ্ডল দল পাল্টে এ বার বিজেপি প্রার্থী। প্রায় ৫৩ শতাংশ হিন্দু ও ৪৭ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই বিধানসভায় ভোট অঙ্কের মাপকাঠি কি হবে সেটাই বড় প্রশ্ন।
রয়েছে ভোট কাটাকুটির খেলাও। বিজেপি হিন্দু ভোট ধরে রাখতে মরিয়া। যদিও সেখানে থাবা বসাতে বদ্ধ পরিকর কংগ্রেস ও তৃণমূল। আবার বিজেপির কাঁটা রয়েছে দুই নির্দল গোঁজ প্রার্থী ডালিম মণ্ডল ও অনিল মণ্ডল। এদের একজন কিসান জাতি, অন্যজন চাঁই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। গৌর অবশ্য বলছেন, ‘‘নির্দল ফ্যাক্টরই নয়, মানিকচকের মানুষ বিজেপিকেই ভোট দেবেন।’’ আর এনআরসি, সিএএ আতঙ্কে সংখ্যালঘু ভোট অনেকটাই কি এবারে তৃণমূলে ঝুঁকে আছে? এই তত্ত্ব না মেনে মোত্তাকিনের দাবি, ‘‘শুধু সংখ্যালঘু নয়, এই বিধানসভার আম-আদমির ভোট এ বার জোটের পালেই।’’
গত নির্বাচনে কংগ্রেস থেকে মোথাবাড়িতে জেতেন সাবিনা ইয়াসমিন। পঞ্চায়েত ভোটের পর তৃণমূলে যোগ দেন। ৬৮ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে সাবিনা এ বারে তৃণমূল প্রার্থী। এ দিকে, গত বিধানসভার পাশাপাশি লোকসভা ভোটেও এই কেন্দ্রে লিড ছিল কংগ্রেসের। একদা সাবিনার সঙ্গী দুলাল শেখ এ বার কংগ্রেস প্রার্থী। বিধানসভা ভোটে তৃতীয় স্থানে থাকলেও লোকসভার নিরিখে এই কেন্দ্রে দ্বিতীয় বিজেপি। প্রার্থী, শ্যামচাঁদ ঘোষ। ফলে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি।
এখানেও কি সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগির সম্ভাবনা? সাবিনা বলছেন, ‘‘বিজেপি এনআরসি ও সিএএ চালুর পক্ষে। এ নিয়ে আতঙ্কিত সংখ্যালঘু মানুষ এটা বুঝেছেন, এর বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিবাদী মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই এই ভোট এবার নেত্রীর।’’ দুলাল অবশ্য বলেন, ‘‘মোথাবাড়ির মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ এবং গনি খানের আদর্শে দীক্ষিত। ধর্মের ভোট এখানে নেই।’’ কী বলছেন বিজেপি প্রার্থী? শ্যামচাঁদের দাবি, সর্ব ধর্মের ভোট এবার তাঁর দিকেই। এই দুই জনপদের বাস্তব জানতে ২ মে-র দিকে তাকিয়ে সব পক্ষই।