মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারী।
নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহত হওয়ার পর ৭২ ঘন্টা কেটে গিয়েছে। ওই বিষয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি নন্দীগ্রামে তাঁর প্রতিপক্ষ শুভেন্দু অধিকারী। কেন? শুক্রবার মনোনয়ন দাখিল করার পর শুভেন্দু বলেছেন, ওই ঘটনা মমতার ‘ব্যক্তিগত’ বিষয়। এটি কোনও ‘রাজনৈতিক’ বা ‘ফৌজদারি’ ঘটনা নয়। শুভেন্দুর কথায়, ‘‘কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরই ওই ঘটনা নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত নয়।’’
প্রসঙ্গত, মমতা নন্দীগ্রামে আহত হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা শুভেন্দু— কেউই কোনও মন্তব্য করেননি। এমনকি, তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেও কোথাও কোনও বিবৃতি দেননি। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে তৃণমূল। তাদের বক্তব্য, মোদী-শাহ বা শুভেন্দু কোনও সৌজন্যেরও ধার ধারেননি। বুধবার সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে ওই ঘটনা ঘটেছিল। আহত মমতা সেদিনই ওই ঘটনার পিছনে চক্রান্তের অভিযোগ করেছিলেন। প্রথমে তিনি বলেছিলেন, তাঁকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পরে বলেন, তাঁর পায়ের উপর গাড়ির দরজা চেপে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূলও সেদিন থেকেই ওই ঘটনার পিছনে বিজেপির চক্রান্ত রয়েছে বলে অভিযোগ করতে শুরু করেছিল। তারা ওই মর্মে নির্বাচন কমিশনের কাছেও অভিযোগ করেছিল। যদিও বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে চক্রান্তের তত্ত্ব ছিল না। বস্তুত, বুধবারের তুলনায় মমতার বৃহস্পতিবারের বিবৃতি অনেকটাই ‘যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত’ ছিল বলে তাঁর ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন।
তবে মমতা চক্রান্তের অভিযোগ করার পরেই বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় ওই ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবি করেছিলেন। রাজ্য দলের প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য দাবি তুলেছিলেন উচ্চপর্যায়ের তদন্তের। কিন্তু শুভেন্দু নিজে কোনও কথা বলেননি। কিন্তু শুক্রবার একটি চ্যানেলকে শুভেন্দু জানান, তিনি জেনেবুঝেই ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। করবেনও না। কারণ, তাঁর কথায়, ‘‘৭২ ঘন্টা হয়েছে ঘটনার। আমি একটি কথাও বলিনি। দলের তরফে কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেছেন। দলের প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন। তাঁরা দলের বক্তব্য জানিয়েছেন।’’
পাশাপাশিই শুভেন্দু বলেন, ‘‘ওঁকে (মমতাকে) হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন আমাদের নেতানেত্রীরা। তাঁদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। গো ব্যাক স্লোগান দেওয়া হয়েছে। আসলে এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। এর মধ্যে কোনও রাজনৈতিক বিষয় নেই। কোনও ফৌজদারি বিষয়ও নেই। এটা একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়। যে ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কোনও কথাই বলা উচিত নয়। ওঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী এবং গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরাই বলতে পারবেন। তাঁরাই ঘটনার আসল প্রত্যক্ষদর্শী। ওঁদের প্রশ্ন করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কী ভাবে লোহার থামে গাড়ির দরজা লেগেছে, কী ভাবে ঘটনা ঘটেছে, ওঁদের কাছে জানতে চাইলেই সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে!’’ প্রসঙ্গত, ওইদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের মতে, মমতা গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসেছিলেন। গাড়ির দরজা খানিকটা খোলা ছিল। রাস্তার পাশের একটি লোহার থামে লেগে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মমতার বাঁ পায়ের গোড়ালি তখন দরজার নীচে পিষ্ট হয়। তাতেই আঘাত লাগে তাঁর।
তবে তৃণমূল তা-ও মানতে নারাজ। বৃহস্পতিবারই রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম মমতার সাদা গাড়িটি সংবাদমাধ্যমের সামনে পেশ করেন। এবং তিনি দেখান, গাড়ির দরজায় কোনও দাগ নেই। ববির বক্তব্য, ‘‘লোহার থামে ধাক্কা খেয়ে দরজা বন্ধ হলে তো গাড়ির দরজার গায়ে ঘষা লাগার স্পষ্ট দাগ থাকত।’’ যদিও বিজেপি এখনও লোহার থামের তত্ত্বেই বিশ্বাস রাখছে। পাশাপাশিই, তারা বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক’ ভাবে ব্যবহার করারও চেষ্টা করছে। মমতা নিজে চক্রান্তের তত্ত্ব থেকে সরে এলেও বিজেপি তাঁর প্রথমদিনের বক্তব্য টেনে বলছেন, চক্রান্তের কথা বলে মমতা নন্দীগ্রামের মানুষকে অপমান করেছেন। শুক্রবার শুভেন্দুও সেই একই কথা বলেছেন। নন্দীগ্রামের বিজেপি প্রার্থীর কথায়, ‘‘উনি নন্দীগ্রামের মানুষকে অপমান করে গিয়েছেন!’’ কিন্তু তিনি কি মুখ্যমন্ত্রী মমতার দ্রুত আরোগ্য কমানাও করবেন না? হাত জোড় করে শুভেন্দুর জবাব, ‘‘আমরা তো চাই, সকলেই একশ বছর বাঁচুন! শুধু মমতা’জি নন, সকলেই যেন শতায়ু হন।’’
নন্দীগ্রামের লড়াইকে ‘ব্যক্তিগত লড়াই’ নয়। ‘আদর্শের লড়াই’ বলে বর্ণনা করেছেন শুভেন্দু। তাঁর কথায়, ‘‘এটা একটা সাধারণ ভোট। বিরাট কোনও চ্যালেঞ্জ নয়। গত লোকসভা ভোটের সময় থেকে ওই এলাকায় বিজেপি-র জনপ্রিয়তা বেড়েছে। কারণ, লোকে মোদী’জি আর বিজেপি-র দিকে চলে গিয়েছে। তখন বিজেপি-র সাংগঠনিক শক্তি অত ছিল না। কিন্তু আমজনতা বিজেপি-কে ১৮টা আসনে জিতিয়ে দিয়েছিল। এবার তো বিজেপি সাংগঠনিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে নেমেছে!’’ শুভেন্দুর আরও বক্তব্য, ‘‘নন্দীগ্রামের জন্য সাংসদ তহবিল থেকে কাজ করেছি। দলের তরফে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রামের জন্য বহু কাজ করেছে। ছোট ছোট কাজ করিয়েছি বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি লিখে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ বছর পর নন্দীগ্রামে এসেছেন। আমরা ১০ বছর আগেও যেতাম। এখনও যাই। ১০ বছর পরেও যাব। মমতা এখন মন্দিরে যাচ্ছেন। কারণ, বাংলার মানুষ তাঁর তোষণের রাজনীতি ধরে ফেলেছে। তাই এখন তিনি মন্দিরে মন্দিরে ঘুরছেন।’’