করোনার জেরে নানা নিষেধাজ্ঞা চলছে, তার মধ্যেই ভোটের ফল ঘোষণা। দু’য়ে মিলে ব্যবসার চেয়ে বড়বাজার জুড়ে রবিবার যেন আরও বেশি হাজির রাজনীতি। বিজেপির পতাকায় মোড়া পাড়ায় বসে রাজেশ্বর গুপ্ত নামে এক ব্যক্তি বললেন, “এমন ফল ভাবতেই পারছি না। জোড়াসাঁকো কেন্দ্রেও বিজেপি হারল? হিন্দিভাষী বলে নয়, এমনিই মোদীকে পছন্দ করতাম।” কয়েক মুহূর্ত থেমে বললেন, “চিন্তা হচ্ছে, হিন্দিভাষী বলেই আমাদের না আবার ভুগতে হয়।” পাশেই দাঁড়ানো সুরেশ ঝা নামে এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করলেন, “দিদি তো হিন্দি ভোটও পেয়েছেন। ভাষার জন্য কেন ভুগতে হবে? বরং উল্টোপাল্টা কেউ জিতে এসে যে ভোগায়নি, সেটাই বড়।”
কয়েক পা এগিয়েই পোস্তার ভাঙা উড়ালপুলের নীচে চায়ের দোকানে চলছে টিভি। এক জনকে আর এক জনের টেক্কা দেওয়ার খবর উড়ে যাচ্ছে গরম চা-সামোসার সঙ্গে। দোকানদার কখনও বলছেন, “এই তো দিদি এগোলো। শুভেন্দু পিছোল।” কারও থেকে আবার দাম নিয়েই বলছেন, “বিজেপি বাহার। এ বার দিদিরই সরকার!” সেতু ভাঙার রাগ নেই? স্পষ্ট জবাব এল, “বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। রাগ অনেকেরই গলে গিয়েছে। কিন্তু চা ফোটাতে যে টাকার গ্যাস পুড়ছে, সেই জ্বালা যাচ্ছে না।” সেখানেই এক ব্যক্তি বললেন, “ভাষা, ধর্ম দিয়ে ভাগ করতে চাওয়া হয়েছে বলেই সব ভাষা, সব ধর্ম এক জায়গায় ভোট দিয়েছে। ভাগের রাজনীতি হেরেছে। যাঁরা ফের এই পথে হাঁটবেন, আবার ভুগবেন।”
এ ভাবেই ভোটের ফল যত স্পষ্ট হয়েছে, ততই যেন শহরে গত কয়েক দিনে তৈরি হওয়া ভাষা ও ধর্মের ব্যবধান ঘুচে গিয়েছে। অনেকেরই দাবি, এই ব্যবধানই এমন রূপ নিয়েছিল যে এক দল মানুষ নিজেদের সংখ্যালঘু বলে মনে করতে শুরু করেছিলেন। সংখ্যাগুরুরা দাবি করছিলেন, রাজ্যের হিতাহিতের নির্ধারক তাঁরাই। পাড়ার বহু ক্লাবেও এই ভাষা আর প্রভাবের নিরিখেই ক্ষমতার বদল ঘটে গিয়েছিল বলে দাবি। ভবানীপুরের একটি পাড়ার তেলুগু পরিবারের সদস্যের মন্তব্য, “বহু বছর ধরে এ রাজ্যে আছি। বাংলাটাও আমাদের ভাষা। গত কয়েক দিনে ভোট ঘিরে নিজেদের কেমন ভিন্ রাজ্যের বলে মনে হতে শুরু করেছিল। এই ফলাফল নিশ্চয় প্রমাণ করবে যে শুধু একটা সম্প্রদায়ের ভোট দিয়ে এত বড় জয় সম্ভব নয়।” একই দাবি ভবানীপুরেরই বাসিন্দা সোনালি তামাংয়ের। তিনি বললেন, “কেউ অন্য ভাষা বলে মানেই সে বাংলার বিরোধী? সেই অন্যায় ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাঁরা মেরুকরণকে প্রশয় দিয়েছেন, তাঁরাও সংযত হোন। এই ভোটের ফলে বিভেদ ঘুচল ভাষা আর ধর্মের।”
লেক টাউনের মেহতা পরিবারের আবার দাবি, “বাংলা ভাষার নকল করতে গিয়েই মোদী ডুবেছেন। তাঁর মুখে পদ্ম শব্দটি শুনে লোক আরও বেশি করে ভেবেছেন, তিনি বহিরাগত। আমাদের পূর্বপুরুষ যাঁরা বহু বছর ধরে এ শহরে থেকেছেন, তাঁদের বা আমাদের কখনও মনে হয়নি আমরা বহিরাগত!”
দুপুরের দিকে ভিড় ছিল পার্ক সার্কাস চত্বরেও। কলকাতার শাহিনবাগ হয়ে ওঠা যে ময়দান সিএএ, এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদে গমগম করত, সেখানেই সবুজ আবির মেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক রুকসানা খাতুন বললেন, “আজকের জয় কিন্তু একটা সম্প্রদায়ের বা ভাষাগোষ্ঠীর নয়। এ জয় মেরুকরণকারীর বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের জয়। কালা আইনের বলে ভূমিহীন হয়ে পড়ার আতঙ্কে থাকা মানুষের জয়। যাঁকে মানুষ এই জয় এনে দিলেন, তাঁরও দায়িত্ব বাড়ল, সম্প্রদায় ছেড়ে মানুষের কথা শুনতে হবে।”