দিলীপ ঘোষ।
সবাই দেখছে প্রচার করছেন। আর দিলীপ ঘোষ বলছেন, ‘‘খেলছি।’’ তিনি কোনও বিধানসভা আসনের প্রার্থী নন। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনি ২৯৪ কেন্দ্রের ‘স্বঘোষিত’ প্রার্থীও নন। রাজ্য সভাপতি হলেও ঘনিষ্ঠরা ‘মুখ্যমন্ত্রী মুখ’ বলে দাবি করলেও দলের ঘোষণায় তিনি বিজেপি-র ‘ক্যাপ্টেন’-ও নন।
নিজে অবশ্য সেটাই মনে করছেন আর ছুটছেন। আসলে নির্বাচনী ময়দানে দিলীপ ফুটবলের পরিভাষায় ‘উঠে নেমে’ খেলছেন। প্রচারকে ‘খেলা’ মনে করাটাও তাঁর নিজস্ব। বলছেন, “খেলতে খেলতে জিতে গেলাম। সবে তো তৃতীয় দফা! আট ম্যাচের সিরিজে এখনও তো পাঁচটা ওয়ান ডে বাকি! আমার রোড-শো গুলো দেখুন। ভিড়ই বলে দিচ্ছে, আমরা জিতে গিয়েছি। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন।’’
এ সব যখন বলছেন, তখন তাঁর হাত কিন্তু থেমে নেই। নির্বাচনের প্রচারের জন্য যে গাড়িটি তিনি বানিয়েছেন (যাকে অনেকে ‘দিলীপ ঘোষের রথ’ বলছে), তার ছাদে দাঁড়িয়ে মুখ চালিয়ে গেলেও হাত থামছে না। ফুল ছুড়ে চলেছেন। এই প্রচারের ছবি দেখা গেল গত মঙ্গলবার। রাজ্যে যখন তৃতীয় দফায় ৩১ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলছিল, তখন দিলীপ ছিলেন হুগলি জেলায়। ১০ এপ্রিল ভোটগ্রহণ, এমন ছ’টি বিধানসভা আসনে তাঁর রোড-শো। সকালে কলকাতা থেকে চুঁচু়ড়া হেলিকপ্টারে আর বাকি দিন গাড়িতে। আনন্দবাজার ডিজিটাল সঙ্গী ছিল মঙ্গলের দিলীপ-সফরে। আগেই শর্ত ছিল, “আমার প্রচার দেখতে হলে আমার গাড়িতেই থাকতে হবে। তবেই ‘খেলা’ বোঝা যাবে।” দাবি মেনে নিলেও মনে প্রশ্ন ছিল, অপছন্দের কথা বললে ‘রগড়ে’ দেবেন না তো!
দলীয় প্রার্থীর হাতে লজেন্স তুলে দিচ্ছেন দিলীপ ঘোষ।
সাক্ষাতের সময় ঠিক ছিল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা। দমদম বিমানবন্দর। বোর্ডিং পাস সংগ্রহ থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের ছাড় পেতে পেতে সাড়ে ৯টা। হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে উড়তে ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১০টার ঘরে। বিমানবন্দরের বাসেই শুরু হল কথা। পাশের সিটে বসে শোনালেন, “আমার প্রচার কিন্তু রোজকার। সাতসকালে প্রাতর্ভ্রমণ দিয়ে শুরু আর মাঝরাত পর্যন্ত মিটিং। ডে-নাইট ম্যাচ।”
তৃণমূলের ‘খেলা হবে’ স্লোগানটাকে তবে বিজেপি-ও স্বীকৃতি দিয়ে দিল? নরেন্দ্র মোদী থেকে দিলীপ— সকলেই তো ‘খেলা খেলা’ করে চলেছেন। হাসতে হাসতে দিলীপের জবাব, “কারও কিছু নিইনি। আমি অনেক আগেই ‘স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট’ খুলেছি। দেখবেন কেমন খেলতে খেলতে প্রচার করব। রোজই তাই করি। আর এমনি এমনি খেলি না। সকালে আগে ওয়ার্ম-আপ আর জগিং। তারপর মাঠ। সে সব সেরেই বিমানবন্দরে এসেছি।” এটা ঠিক যে, রুটিনে ফাঁক দেন না দিলীপ। ১০টা– ৫টা কেরানির মতোও নন। রোজই ‘ওভারটাইম’ আছে।
ওয়ার্ম আপ ছাড়া মাঠে নামা যে ঠিক নয়, সেটা বোঝা গেল আকাশ থেকে মাটিতে নামার পরে পরেই। একদিনে ছ’টা বিধানসভা এলাকা। ছুট আর ছুট। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ছুট। দিলীপ যখন আকাশে, তখন চুঁচুড়ায় অপেক্ষায় সাংসদ প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়। আবার চুঁচুড়ার রোড-শো যখন চলছে, তখন সপ্তগ্রামের কর্মসূচির সময় হয়ে গিয়েছে। এর পরে সবই শুধু পিছোচ্ছে। শেষ কর্মসূচি ছিল শ্রীরামপুরে সন্ধ্যা ৬টায়। কিন্তু দিলীপ যখন পৌঁছলেন তখন রাত ১০টা।
সমর্থকদের মাঝে।
দেখা গেল, বিজেপি প্রার্থী-নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কাছে শুধু ‘দিলীপদা’ আকর্ষণ নন। দাদার গাড়িটিও আকর্ষণের। সে গাড়ির দর্শন অবশ্য অনেক পরে পাওয়া গেল। মধ্যাহ্নভোজনের পর। চুঁচুড়ায় দিলীপের বহুআক্রান্ত স্করপিওতে একলা রেখে উঠে গেলেন হুডখোলা জিপে। বুধবার শীতলকুচিতে যে গাড়িতে হামলা হল, সেটি নয়। রবীন্দ্রনগর থেকে সুগন্ধা। সেটা শেষ করে ফিরলেন স্করপিওতে। গলায় খান পাঁচেক রজনীগন্ধার মালা। অকৃতদার দিলীপ ‘মালাবদল’-এর পথ না মাড়ালেও রজনীগন্ধায় মন্দ লাগেন না। প্রশংসা শুনে বললেন, “ফুল নিলে ফুল দিতে হয়। ফুলের মতো প্রাণ দিতে হয়।” এ তো কবি জসীমউদ্দিনের লাইন! এড়িয়ে গেলেন। বললেন, “অনেক আশা নিয়ে মানুষ ঘাসফুল এনেছিলেন। কিন্তু নিরাশ হতে হয়েছে। এ বার পদ্মফুলে মানুষ ভরসা রাখছেন। আমার অনেক দায়িত্ব। অমিত’জির নির্দেশ মতো ২০০-র বেশি প্রার্থীকে জেতাতেই হবে। তাই দিনরাত এক করে পরিশ্রম করছি। গত দু’মাসে যেটুকু ফরসা ছিলাম সেটুকুও আর নেই। টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝাঁকুনি সামলে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ নয়।” এটা-সেটা বলতে বলতে এসে গেল বাঁশবেড়িয়ার গন্ধেশ্বরী মোড়। সপ্তগ্রাম বিধানসভা। রোড-শো চলল প্রায় ১২ কিলোমিটার। শেষ মগরা থানার কাছে। সেটা আবার বলাগড় বিধানসভা এলাকা। খাওয়াদাওয়ার সামান্য বিরতি। কিন্তু সেখানেও দিলীপের খাওয়ার থেকে প্রচারে বেশি মন। খেতে খেতেই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আড্ডার ছলে বৈঠক করছিলেন। যে কর্মীর বাড়িতে পিত্তরক্ষার ব্যবস্থা, সেখানে যে পুরনো যাতায়াত, সেটাও বোঝা গেল। বিজেপি নেতা স্বামী সম্পর্কে গৃহকর্ত্ৰীর অনুযোগ, “আমি চুনোমাছ আনতে বলেছিলাম। সকাল থেকে এত ব্যস্ত, যে সেটাও আনেনি।” দিলীপও চুনো ‘মিস’ করার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে জানালেন, ভোট মিটলে খেয়ে যাবেন। বললেন, “ওটা ডিউ রইল। তবে এই শুক্তোটা সে দিন আবার চাই।” খাওয়া শেষ করেই একটি জাতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকার। এর পরে এল ‘দাদা-গাড়ি’ পর্ব। ততক্ষণে ‘দিলীপ ঘোষের রথ’ কলকাতা থেকে এসে গিয়েছে। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। মাঝদুপুরে স্থানীয় কর্মীর বাড়িতে খেয়ে যখন পথে নামলেন, বাইরে উৎসাহী কর্মীদের ভিড় থেকে স্লোগান উঠল, ‘‘দিলীপ’দা জিন্দাবাদ!’’ খুশি হলেন না দিলীপ। উল্টো বললেন, “চলো-চলো! মিছিলে গিয়ে স্লোগান হবে। ভরদুপুরে মানুষের ঘুম নষ্ট করতে হবে না।” যদিও জনতা শুনল না।
দিলীপের রথ আসলে একটি ‘ভ্যান’। বিলাসবহুলই বলা যায়। বসা, শোয়া, টিভি দেখা, শৌচাগার, ফ্রিজ— সবই আছে। তবে চৈত্রের গরমের তুলনায় ঠান্ডা করার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। গাড়ির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছাদ। সেখানে ওঠার জন্য গাড়ির ভিতরেই লিফ্ট। ওপরে রেলিং লাগানো হয়ে গেল পান্ডুয়া পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই। লিফ্টে দিলীপের সঙ্গেই ছাদে উঠল গাঁদাফুলের বস্তা। শুরু হল ‘দাদা-গাড়ি’-র দাদাগিরি।
শুরু হল ‘খেলা’। ফুল নিয়ে খেলতে শুরু করলেন দিলীপ। পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থী হাত নাড়ছেন। আর দিলীপ ফুল ছুঁড়ছেন ‘টিপ’ করে করে। বাড়ির ছাদে, জানলায়, বারান্দায় লোক দেখলেই ফুল। মাঝে মাঝে হরির লুটের মতো। তবে বেশিটাই লক্ষ্য স্থির করে। তা লোফার জন্য মানুষের চেষ্টাও কম নয়। কেউ ভাল ক্যাচ লুফলে হাততালিও দিচ্ছেন। আর বলছেন, “এই ভাবে খেলতে খেলতেই ভোটটা জিতে গেলাম। দেখুন, মানুষের মধ্যে ফুল নেওয়ার কেমন আগ্রহ।” দাবি মিথ্যে নয়। অনেকেই ফুল নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে পকেটে রাখছেন। লুফতে না-পারা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে যত্নে রাখছেন কেউ কেউ। বোঝা গেল রথ, রথী, রথের ফুল— সবেরই বেশ চাহিদা আছে। বস্তুত, রথীর হাত থেকে লজেন্স প্রসাদ নেওয়ার আগ্রহও যথেষ্ট। দিলীপের সংগ্রেহে সব সময়ই লজেন্সের স্টক। গাড়িতে মস্ত বড় কৌটো।
পথে ,পথে রথে দিলীপ।
ভিড় থেকে ‘ও দিলীপ’দা’ ডাক আসছে অহরহ। দিলীপও দেখা গেল চেনেন অনেককেই। ‘‘আরে বিশ্বজিৎ কেমন আছো’’, ‘‘সুকমল, সব ঠিক আছে তো’’ মার্কা ভিড়ের লোকেদের সঙ্গে টুকটাক কথা সারছেন। এত কর্মীকে নামে চেনেন? “সকলের নাম মনে রাখতে পারি না। তবে এ সব জায়গায় যখন বিজেপি-র কিছু ছিল না, তখন থেকে আসছি। মাত্র ৫০ জন নিয়েও বৈঠক করেছি। এখন সেটাই হাজার হাজার হয়েছে।” দিলীপ কি একটু ‘অহঙ্কার’ দেখালেন? তবে মাত্র ছ’বছরে বাংলায় বিজেপি-র চেহারা বদলানোয় তাঁর ভূমিকা তো আছেই। লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদী হাওয়া’ থাকলেও সেটা কাজে লাগাতে পরিশ্রমই দিলীপের পুঁজি ছিল। সাফল্যও পেয়েছেন। ২০১৬-র বিধানসভা, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হিসেবে জেতার পাশাপাশি গোটা রাজ্যে সফর করেছেন। যা এ বারও করছেন। গোটা দিনে অনেকটা সময় ‘অতীত রোমন্থন’ করে কাটল। দিলীপ বোঝাতে চাইলেন, কলকাতায় ৬ নম্বর মুরলিধর সেন লেনের বিজেপি রাজ্য দফতর থেকে নবান্নের দূরত্ব কিলোমিটার দশেক হলেও আসলে সেটা নয়। মাঝখানে রয়েছে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ অনেক অনেক ‘স্টপেজ’। সেই সব পথই মাড়িয়েছেন তিনি। ‘রথ’ নিয়ে দক্ষিণবঙ্গ আর হেলিকপ্টার এবং গাড়িতে উত্তরবঙ্গ। কোথায়, কী ভাবে আক্রান্ত হয়েও ‘লড়াই’ করেছেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন, “ভয় না পেয়ে কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েই বিজেপি-কে শূন্য থেকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছি।”
দিনের শেষে এলেন চন্দননগরে। প্রার্থী রাজ্য বিজেপি-তে তাঁর আপনজন হিসেবে পরিচিত দীপাঞ্জন গুহ। দিনে প্রথম মাইক হাতে নিলেন। ততক্ষণে তৃতীয় দফার ঘটনাবহুল ভোটগ্রহণ শেষ হয়ে গিয়েছে। ততক্ষণে সারাদিন কোথায় কী হল, খবর না রাখা দিলীপ বলাগড় থেকে অতীতের ফরাসডাঙা ৪০ মিনিটের পথে মোবাইলে খবর দেখে গোটা দিনের আপডেট নিয়ে নিয়েছেন। বক্তৃতায় শোনালেন, “তিন দফায় যা যা হয়েছে তাতেই পরিষ্কার যে, দিদিভাই গোল খেয়ে গিয়েছেন।”
অবশেষে শ্রীরামপুরে রোড-শো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার শেষে ভিড় পাতলা হয়ে গিয়েছে। দিলীপের অবশ্য তাতে কিছু আসে-যায় না। ফুল ছুড়লেন। ফুলের ঘায়ে ভোট চাইলেন। প্রায় মধ্যরাতে তাঁর গাড়ি ছুটল নিউ টাউনের বাড়ির পথে। রাত কাটিয়ে বুধবার সকাল ৮টায় আবার রওনা। তিনদিনের উত্তরবঙ্গ সফর। তার আগে প্রত্যয়ী গলায় দাবি করে গেলেন, “ফুল ফুটে গিয়েছে। গেরুয়া বসন্তও এসে গিয়েছে।”