জল স্তব্ধ: গজলডোবার ব্যারাজ নিজস্ব চিত্র
সেই নদী পাহাড় কেটে নামছে, বইছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। সেই নদী ছুঁয়ে যাচ্ছে চা বাগান, ধানের খেতও। সেই নদী কখনও বাঁ দিক ঘেঁষা, আবার কখনও ডান দিকে সরে সরে আসে। সেই নদীর বুকে মাথা তোলে বালির চর। সেই নদী এক দেশ থেকে বয়ে যায় আরেক দেশে। দুই দেশে কত মা-বাবা ভালবেসে সেই নদীর নামে রাখে সন্তানের নাম। চৈত্রের শুরুতে জল কমতে থাকে। মাঝিরা বলে জল ‘বাড়ন্ত’। এ যেন সেই চাল ফুরলে ‘চাল বাড়ন্ত’ বলার মতোই বাংলা প্রথা। আসলে, এ নদীতে জল কমে যায়, সে কথা ওঁরা মুখেও আনতে পারবেন না।
সেই নদীর নাম তিস্তা। নদীর পাড়ে ঘরকন্না হাজার হাজার পরিবারের। কেউ নদীতে মাছ ধরে ঘর চালায়। কারও চরের জমিতে চাষ। কোথাও নদীর পাশে ধর্মস্থান। নদীতে স্নান সেরে পুণ্যার্থীরা পুজো দিতে যান। নদীর পাড়েই কেউ ফুল-ধূপকাঠি বেচেন, কেউ চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালান। এলাকার বাসিন্দারা বলে, সে-ও তো তিস্তার দান। সেই নদী জানে বাঘারুদের কথা! সেই নদী জানে থমকে থাকা এক প্রকল্পের কথা। সেই নদী জানে অসীমাংসিত এক আর্ন্তজাতিক চুক্তির কথা!
তিস্তাতেও ডিঙি নৌকা ভাসতে দেখা যায়। চৈত্রের রোদ মাথায় নিয়ে নদীতে ঘুরেছেন। দুপুরে ঘাটে নৌকো বাঁধছিলেন তরিবুল হোসেন। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির মুখ থেকে বাঁধা গামছা সরিয়ে দেখান সকালের পাওয়া চকচকে বোরোলি। ভোট আসছে, জানেন? তরিবুলের মুখে লাজুক হাসি! উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার থেকে জালকাঠি পাওয়া তরিবুল বলেন, “ভোট এলেই সকলে তো তিস্তার জলের কথা বলে।” তিস্তার জল কোন দেশের কতটা, তা নিয়ে ফের ভোটের আগে অঙ্ক শুরু হয়। ভারত-বাংলাদেশের তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি আটকে রাখা নিয়ে শুরু হয় দাবি, পাল্টা দাবি। তখনই অন্য পক্ষ দাবি করে, তিস্তার সেচের জল তো জমিতেই পৌঁছল না। সত্তরের দশকে এই নদীকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা হয়েছিল রাজ্যের সবচেয়ে বড় কৃষি প্রকল্পের। বলা হয়েছিল, প্রকল্পে বদলে যাবে গোটা উত্তরবঙ্গের চাষের চেহারা। সেই প্রকল্পের নয় ভাগের এক ভাগও শেষ হয়নি।
তিস্তার বালিতে চাল, তরমুজ চাষ করে সম্বৎসর কেটে যায় ময়নাগুড়ি, মেখলিগঞ্জের চাষিদের। তিন দেশের দশ জেলা দিয়ে বয়ে চলা এই নদীর স্রোতের মতোই সেই চাষিদেরও এক জমিতে টিকে থাকার উপায় নেই। সরকারি স্বত্ব নেই দু’পারের জমির। পাট্টার দাবিতে কত আন্দোলন হয়েছে। শেষে এক দিন দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের চরিত্র বাঘারু পার্টির পতাকা ফেলে হাঁটা দিয়েছিল বহু দূরে। বাঘারু জানিয়ে দিয়েছিল, তার কোনও মিছিল নেই। যদিও তার পরেও ভোট আসে। তিস্তা পাড় ধরে মিছিল এগিয়ে চলে নানা রঙের পতাকা নিয়ে। কতশত বাঘারুর চোখ সেই সব মিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কতশত বাঘারুর চোখ মাটিতে নেমে আসে। তিস্তা বয়ে যায়, বইতেই থাকে।