প্রতিপক্ষ: শমীক ভট্টাচার্য, অদিতি মুন্সি এবং শুভজিৎ দাশগুপ্ত।
‘নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে’— অদিতি মুন্সির গলায় রবিঠাকুরের এই গান শুনে প্রচারসভায় মহিলারা সমস্বরে বলছেন, ‘‘হবেই হবে।’’
কী হবে এবং আদৌ তা হবে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে স্রেফ তৃণমূল প্রার্থী অদিতির কন্ঠেই নয়, বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য কিংবা সিপিএম প্রার্থী শুভজিৎ দাশগুপ্তের মনোভাবেও সেই ভরসার বাণীই ধরা পড়ছে। প্রার্থীরা সকলেই একযোগে ভরসা রাখতে চাইছেন ভোটারদের উপরে।
কিন্তু ভোটারেরা কী চাইছেন?
সেখানেই গোলকধাঁধা। ভোটারদের যে মনোভাব প্রকাশ্যে দৃশ্যমান, ভোটবাক্সেও কি তারই প্রতিফলন ঘটবে? উত্তরটা স্পষ্ট নয় কারও কাছেই। খালপাড়ের জ্যোতি থেকে সাতগাছির গদাই, জগৎপুরের তাপস থেকে বাগুইআটির মন্মথ কিংবা কেষ্টপুরের শ্রাবণী— নতুন প্রজন্মের সকলেরই দাবি, কাজ চাই। দু’মুঠো ভাত চাই।
তাঁদের এ হেন দাবিদাওয়ার কথা শুনে প্রথমে মনে হতে পারে, ভোট সম্ভবত জোটের ট্রেন ধরতে চাইছে। কিন্তু কর্মসংস্থান কারা করবে, সে প্রশ্নে ভোটারদের অনেকেরই উত্তর বিজেপির দিকে ইঙ্গিত করছে। যদিও ধর্ম, বিভাজনের রাজনীতি, ভাষা সন্ত্রাস, মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে তাঁরাই আবার বিজেপি-কে রীতিমতো তুলোধনা করছেন। তাঁদের মুখে এক দিকে যেমন তৃণমূলের ‘আধিপত্যবাদের’ সমালোচনা রয়েছে, তেমনই রাজ্য সরকারের নানাবিধ প্রকল্পের প্রশংসাও শোনা যাচ্ছে।
সদ্য রাজনীতিতে পা দেওয়া তৃণমূল প্রার্থী অদিতি বলছেন, ‘‘মানুষকে সম্মান দিতে হবে। রাজনীতি মানে মানুষের উন্নয়ন। তাই নির্বাচনকে প্রতিযোগিতা হিসেবে ভাবি না। সেই উন্নয়নের পথ দেখিয়েছেন জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে শমীক পাল্টা বলছেন, ‘‘তোমারও তো শ্রান্ত হল মুঠি। অন্যায় হবে না- নাও ছুটি।’’ তৃণমূল কর্মীদের দাবি, মমতা বাঙালির হৃদয়ে বাস করেন। বিজেপি সেটা যত তাড়াতাড়ি বোঝে, ততই মঙ্গল। বামেরা আবার বলছেন, ‘‘মানুষ দু’টো দলকেই ছুটি দেবে।’’ এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক তরজা যাতে লাগামছাড়া ভাষা সন্ত্রাসে পরিণত না হয়, সে দিকে নজর রাখা উচিত সকলেরই।
এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সরকারি পরিষেবা ও স্থানীয় সমস্যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সেখানে। দক্ষিণ দমদম পুরসভার আটটি এবং বিধাননগর পুরসভার ১৬টি ওয়ার্ড রয়েছে এই বিধানসভা কেন্দ্রে। পানীয় জল, রাস্তা, নিকাশি, ট্রেড লাইসেন্স ও মিউটেশন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ সামলাতে হচ্ছে শাসকদলকে। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, পরিস্রুত পানীয় জলের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। বিজেপি প্রার্থী শমীকবাবুর আবার অভিযোগ, ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে ওই এলাকাটিকে। ক্ষমতায় এলে পরিকাঠামো থেকে কর্মসংস্থানের সুসংহত পরিকল্পনা করবেন তাঁরা। বাম প্রার্থী শুভজিৎবাবুর অভিযোগ, রাজারহাট গোপালপুর উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এলাকার উন্নয়নের দিশা তৈরি করবেন তাঁরাই।
তবে প্রার্থীদের ব্যক্তি পরিচিতিও এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে। শিল্পী হিসেবে অদিতি মুন্সির স্বতন্ত্র পরিচিতি রয়েছে রাজ্য জুড়ে। মহিলা ভোটারদের মধ্যে তাঁর সেই জনপ্রিয়তার প্রভাব হামেশাই দেখা যাচ্ছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দা অদিতি শিল্পীর চেয়ে ‘ঘরের মেয়ে’ পরিচয়কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
উল্টো দিকে, বিজেপি প্রার্থী শমীকবাবু সুবক্তা, রাজ্য রাজনীতির পরিচিত মুখ। ব্যক্তি পরিচিতি নিয়ে ভাবিত নন তিনি। তাঁর মতে, ‘‘প্রতিপক্ষ কেউ নেই। একটাই বিষয়, ডবল ইঞ্জিন। সেই হাওয়ায় রাজ্যে ২০০ আসন সুনিশ্চিত করবে দল।’’ বাম প্রার্থী শুভজিৎবাবুও স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁর মতে, দলের নীতি, আদর্শ এবং কাজই মুখ্য। সরকারে না থেকেও করোনাকালে তাঁদের লাগাতার কাজ দেখেছেন রাজ্যবাসী। মানুষ বুঝেছেন, ভোটে বাকিদেরও বুঝিয়ে দেবেন।
নির্বাচনী পরিসংখ্যান অবশ্য কিছু সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে। ২০১৯ সালে লোকসভার নিরিখে এই বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী শমীকবাবু ৭৪৩ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। ২০১১ ও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জয়ী হলেও এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট ক্রমশ বেড়েছে। তবে তৃণমূলের ভোট কমেছে খুব সামান্যই। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ধস নেমেছিল বাম ও কংগ্রেসের ভোটে। সেখানেই বিজেপি-র ভোট বাড়ে অনেকটা। বর্তমানে বহুতল থেকে খালপাড় লাগোয়া এলাকায় বিজেপির প্রভাব খুব বেশি করে চোখে পড়ছে। শমীকবাবুর দাবি, তাঁদের কর্মী-সংখ্যা অন্তত পাঁচ গুণ বেড়েছে। লোকসভা ভোটের তুলনায় এ বার বাম ও কংগ্রেসের নড়াচড়া অনেকটাই বেশি। করোনাকালে তাঁদের কাজের কথা উঠে এসেছে বাসিন্দাদের আলোচনাতেও। আবার সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি প্রার্থী নির্বাচন এ বার তৃণমূলকে বাড়তি সুবিধা দেবে বলেও মনে করছেন অনেকে। যদিও তাঁদেরই একাংশের মতে, এই বিধানসভা এলাকায় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া বইছে ভালই।
কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান? রাজ্য না কেন্দ্র?
বামেদের আশা, তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধেই যাবে সেই হাওয়া। তৃণমূলের দাবি, তাদের উপরেই ভরসা রাখবেন মানুষ। বিজেপি বলছে, এ বার হবে আসল পরিবর্তন। যদিও দলগুলির সাংগঠনিক শক্তি তাদের এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। রাজনৈতিক মহল অবশ্য মনে করছে, ভোট ‘ম্যানেজারদের’ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া, দল বদল, অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে।
তৃণমূল শিবির এখানে একটা ঐক্যের ছবি তুলে ধরতে চাইছে। যার নেপথ্য কারিগর অদিতির স্বামী তথা তৃণমূল নেতা দেবরাজ চক্রবর্তী। বিজেপি-ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বলে কিছু মানতে নারাজ। তবে প্রার্থী হিসেবে
শমীকের নাম ঘোষণার পরেই বিজেপি কর্মীদের একাংশের বিক্ষোভ, অশান্তির ছবি কিন্তু অন্য কথা বলছে। বাম-কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি আগের মতো নয়। তবে কংগ্রেস নেতা সোমেশ্বর বাগুইয়ের কথায়, ‘‘এ বার অনেক সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে লড়াই করছে জোট। তৃণমূল কিংবা বিজেপি ইতিমধ্যেই তা টের পাচ্ছে।’’
রাজনৈতিক দলগুলির এ সব দাবি কতটা সত্যি, তা আগামী দিনে প্রমাণিত হবে। তবে এই বিধানসভায় এক-একটি দলের নিশ্চিত আর অনিশ্চিত ভোটের ব্যবধান যে বাড়ছে, তাতে সন্দেহ নেই। ফলে উপর উপর আত্মবিশ্বাসীর ভাব দেখালেও ভোটের অঙ্ক যে জটিল, মানছে সব পক্ষই। আপাতত দেখার, সেই গোলকধাঁধায় কারা, কী ভাবে পথ খুঁজে পায়।