পথে-প্রান্তরে: গ্রামীণ হাওড়ায় নির্বাচন আগামী ৬ এপ্রিল। ভোট চাইতে শ্যামপুরে হাজির বিজেপি প্রার্থী তনুশ্রী চক্রবর্তী। ছবি: সুব্রত জানা
টোটো-সওয়ারি তনুশ্রী চক্রবর্তীকে ঘিরে জনা কয়েক গ্রাম্য প্রৌঢ়। “দিদি, দেওয়াল লেখার লোক দাও গো! আমরা বামফ্রন্ট করতাম। পদ্ম আঁকতে গিয়ে মোচা হয়ে যাচ্ছে!” সরু, আঁকাবাঁকা পথে নায়িকা-প্রার্থীর গ্রামদর্শন শ্যামপুর-১ ব্লকের বারগ্রামে। “দিদি কমার্শিয়াল বই তত না-করলেও মিষ্টি ব্যবহারে সবার সঙ্গে মিশে গেছেন”, নিশ্চিন্ত আদি-নব্য বিজেপি নেতারা।
টলিউডের গত পরশুর নায়িকা পাপিয়া অধিকারী নিজেই এক কালের মুখরা সিপিএম সমর্থক। গড়চুমুকের পূর্ব বাসুদেবপুর গ্রামে জনৈক ‘কার্যকর্তা’র বাড়িতে বসে শোনাচ্ছেন তাঁর জীবন বদলে যাওয়ার গল্প। “বামপন্থীদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে মাখামাখিতেই মানসিক ভাবে সরে গেছি। এখন তো পীরজাদার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শারীরিক ভাবেও সরে যেতে হল।” ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটিতে বেদ, উপনিষদ চর্চা। ধ্যানে ভুরুর ফাঁকে ঈশ্বর দর্শনের চেষ্টার কথা শোনাচ্ছিলেন পাপিয়া। তিনি আপ্লুত, “রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ঋষিতুল্য নেতারা আমায় বদলে দিয়েছেন।”
গ্রামীণ হাওড়ার শ্যামপুর এবং উলুবেড়িয়া দক্ষিণ— পাশাপাশি দুই কেন্দ্র যেন টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিরই আগামীর স্টেশন। দুই যুগের দুই নায়িকাই পদ্মবনে পাড়ি দিয়েছেন। পাপিয়ার অভিমান সিরিয়ালে তৃণমূলীদের স্বজনপোষণে। উলুবেড়িয়া দক্ষিণের প্রার্থী শোনাচ্ছেন, যাত্রায় গরিবের টাকা নয়ছয় নিয়ে সংলাপ বলার সময়ে তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যাত্রা-সিনেমার চেনা মুখকে দেখতে সেঁটে থাকা ভিড় মধ্যাহ্নভোজ পর্বেও। দুপুর অবধি প্রচারের পরে ঘর বন্ধ করে এক প্রস্ত মেক-আপ নিলেন। তার পরে খেতে খেতেও দরাজ নিজস্বী বিতরণ। গ্রামের এবড়োখেবড়ো, নড়বড়ে রাস্তার তিনি নাম দিয়েছেন ‘ডান্সিং রোড’!
গৈরিক সংসর্গে পাপিয়ার এক কালের লাস্যময়ী গানেরও মানে পাল্টে গিয়েছে। কখনও দু’কলি গাইছেন, ‘আমি বিবি পায়রা পায়রা’, সঙ্গে ফুটনোট, ‘‘এ পায়রা হোক শান্তির!’’
উলুবেড়িয়া দক্ষিণে পাপিয়া অধিকারী। বুধবার। ছবি: সুব্রত জানা
টোটোয় তনুশ্রীকে ঘোরানোর ফাঁকে বিজেপি-র নানা উপদলের টানাটানিতে খানিক বিরক্ত তাঁর ব্যক্তিগত ম্যানেজারেরা। নায়িকা তবু হাসিটি আলগা হতে দিচ্ছেন না। এ বিভুঁইয়ে অভিভাবকপ্রতিম নেতা অসিত হাজরা, টোটোয় সঙ্গী রূপালি ঘোষেরা ফিসফিসিয়ে বলছেন কোথায় নামতে হবে! পানের বরজের মা চণ্ডীকে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম বা শালপাতায় কালীর প্রসাদী ট্যালটেলে খিচুড়ি আস্বাদন— কিছুতেই না নেই। অমুক বুথের নেত্রীর সামনে নেমে তনুশ্রী বলছেন, “দিদি, তোমার কিন্তু অনেক দায়িত্ব গো!” ১০০ দিনের কাজের মেয়েদের সামনে সংলাপ, “পদ্মফুল জিতলে কিন্তু ২০০ দিন কাজ পাবে! আর তোমার মেয়ে বড় হলেই ব্যাঙ্কে দু’লাখ ঢুকছে!”
সদাশিবপুরে মেনকা সাউয়ের বাড়িতে খেতে ঢুকতেই বিকেল তিনটে। পেটে আগুন নিয়ে তনুশ্রী ফাঁকে ফাঁকে নরম পানীয়েই চুমুক দিচ্ছেন। পাপিয়ার বিজেপিভুক্তি মাঝ ফেব্রুয়ারিতে। অমিত মালব্যের ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি তিনি। আর তনুশ্রীর যোগদান ৮ মার্চ, নারী দিবসে। এক মাসও হয়নি। পুরনো বিজেপি শিল্পীদের পিছনে ফেলে এই দু’জনের টিকিট-লাভ নিয়েও টলিউডের অন্দরে গুঞ্জন। শুনে চোয়াল শক্ত পাপিয়ার, “আমার বিদ্যেবুদ্ধি, রাজনৈতিক শিক্ষা আছে! আই হ্যাভ বিন উইথ দ্য মাটি ফর লং!” শোনা যায়, তনুশ্রীকে বাছাইয়েও খাস দিল্লির হাত। তিনি শুধু বলছেন, “দল একটা কাজ দিয়েছে। মনপ্রাণ ঢেলে করছি!”
অতীতে তনুশ্রীকেও দেখা গিয়েছে মমতার মঞ্চে। জানুয়ারিতে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ নারীবিদ্বেষী ট্রোল-বাহিনীর প্রতিবাদে ধর্মতলার সভাতেও দিদিকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। এখন বলছেন, “ট্রোলদের বিজেপি বলে কেন ধরব! ব্যক্তি মমতার সঙ্গেও লড়াই নয়। কিন্তু বিজেপি দলটাকে আমি নিজেই বেছেছি।”
টোটো-সফরে দুলকি চালে তনুশ্রীর গল্প গোরক্ষপুরের টিকিধারী নেতা জে পি উপাধ্যায়ের সঙ্গে। “জানেন, আমার অভিনীত ছবি গুমনামী ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেল!” প্লাস্টিকের জলের বোতল উপাধ্যায়জি ঝোপে ফেলতেই তাঁকে প্রার্থীর মৃদু বকুনি, “স্যর, এটা কিন্তু ঠিক নয়।” পাপিয়া, তনুশ্রী স্থানীয় অতিথিশালায় মাটি কামড়ে পড়ে। কর্মীদের সঙ্গে রাত পর্যন্ত বৈঠক। পাপিয়ার কথায়, “বড় মেয়ে নানা ভাবে সাহায্য করে। তবে দলই পরিবার এখন।” দোলে এক দিনের জন্য কলকাতায় বাড়ি গিয়েছিলেন তনুশ্রী। মে-তে ফের শুটিংয়ে ফেরার কথা তাঁর। আপাতত ভোটপ্রার্থীর চরিত্রই ‘পাখির চোখ’ মধ্য তিরিশের অভিনেত্রীর জন্য।