ফাইল চিত্র।
কিংবদন্তি ‘শোলে’ ছবিতে জয়ের পকেটে থাকা সেই সিক্কার উদাহরণ উঠে আসছে চর্চায়। যে মুদ্রার দুই পিঠই ছিল একই রকম এবং যে মুদ্রা আকাশে ছুড়ে প্রতি বার টস জিততেন জয় ওরফে অমিতাভ বচ্চন!
এ বারের বিধানসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপির প্রার্থী তালিকা বোঝাতে ওই সিক্কার ব্যবহারই সম্ভবত আদর্শ। পুরুলিয়ার একটি আসন আজসু-কে ছেড়ে রাজ্যে ২৯৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল এবং তার মধ্যে অন্তত ১৫৮ জনই ‘দলবদলু’! গেরুয়া পতাকার তলায় এঁদের বেশির ভাগেরই সমাবেশ হয়েছে তৃণমূল থেকে, কয়েক জন সিপিএম বা কংগ্রেস থেকেও এসেছেন। তৃণমূলে সকলেই যে শুভেন্দু অধিকারী বা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রথম সারিতে ছিলেন, তা অবশ্য নয়। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে ছিলেন, এমন মুখ দিয়েই ভর্তি হয়ে গিয়েছে বিজেপির তালিকা। যা নিয়ে রাজ্যের নানা প্রান্তে বিক্ষোভে দেখিয়েছেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরাই।
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলেও দলবদলু মুখ রয়েছে অন্তত ২২। পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোট থেকে এখনও পর্যন্ত যাঁরা দল বদলে তৃণমূলে এসেছেন এবং জোড়া ফুলে এ বার প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের ধরলে হিসেবটা এই রকম দাঁড়ায়। এঁদের সিংহভাগই আবার এসেছেন কংগ্রেস ও বাম শিবির থেকে। মানস ভুঁইয়া, পরেশ অধিকারী বা শঙ্কর সিংহের মতো এমন বেশ কয়েক জন আছেন, যাঁরা পরপর দু’টো বিধানসভা নির্বাচনে আলাদা দলের হয়ে অন্য দলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সরকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ইনিংসের সময়ে যাঁরা অন্য দল থেকে তৃণমূলে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের কথা ধরলে হিসেব আরও গুলিয়ে যেতে বাধ্য!
‘খেলা হবে’র ভোটে মুখ বদলের এমন খেলা এ বার হয়েছে, যা রাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসে নজির তৈরি করে ফেলেছে। একসঙ্গে এত দলবদলু প্রার্থী এ রাজ্যের ভোটে অতীতে কখনও দেখা যায়নি। বিধানসভার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯৬৭ সালে প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে আরও ১৭ জন বিধায়ক দল ছেড়ে পিডিএফ নামে নতুন মোর্চা গড়েছিলেন। আরও পরবর্তী কালে সেই পিডিএফ থেকে পদত্যাগ করে ৩২ জন বেরিয়ে এসেছিলেন আইএনডিএফ নামে আরও একটি ফ্রন্ট গড়ার জন্য। সেই ’৬৭-র ঘটনাই ছিল বিধানসভায় ইতিপূর্বে সব চেয়ে বেশি দল বদলানোর নজির। যুক্তফ্রন্ট ঘিরে সে আর এক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্মারক হয়ে আছে ওই ঘটনা। মনে রাখতে হবে, জনপ্রতিনিধিদের জন্য এখনকার দলত্যাগ-বিরোধী আইন সে সময়ে ছিল না।
এ বারের ভোটে দলবদলের ঘনঘটাকে প্রচারের হাতিয়ার করেছে বামেরা। তাদের আহ্বান ‘দল বদল নয়, দিন বদল’। রাজ্যের নানা প্রান্তে যে এক ঝাঁক তরুণ মুখকে ভোটের ময়দানে নামিয়েছে সিপিএম, তাঁরা মানুষের কাছে গিয়েও দল না বদলানোর অঙ্গীকার করে আসছেন। কংগ্রেসের তালিকায় পুরনো এবং নবীন সৈনিকদের সমন্বয়ের মাঝে একটি আসনে প্রার্থী আছেন বাম জমানার প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার। সংযুক্ত মোর্চার অপর শরিক ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) তালিকাতেও অন্তত চার জনকে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ বা আগে অন্য দলে ছিলেন। আইএসএফ নেতৃত্বের দাবি, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিকল্প গড়তে অন্য দল থেকে অনেকে এই নবগঠিত মঞ্চে শামিল হচ্ছেন, ‘প্রলোভন’ দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই।
বিজেপি দলবদলুদের টিকিট দেওয়ার রেকর্ড গড়ে ফেলার পরে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের যুক্তি, ‘‘অন্য রাজ্যেও এ রকম হয়েছে এবং তাতে দল সাফল্য পেয়েছে।’’ তাঁর দাবি, অন্য দলের বিতর্কিত বা কলঙ্কিত মুখ বিজেপিতে এসেই ছড়ি ঘোরাতে পারে না। আর রাজ্যে সাফল্য পেলে তাঁরা ‘শুদ্ধকরণ’ করে নবাগতদের দলের মূল স্রোতে মেশানোর ব্যবস্থা করবেন। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘আমাদের দলে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক আন্দোলনে শরিক হয়েছেন আগে। বিজেপির কোনও আন্দোলন নেই, ক্ষমতা দখল ছাড়া কোনও লক্ষ্য নেই। লোকসভা ভোটের পরের দু’বছরে তারা অন্য দল থেকে ধরে ধরে এনে ভোটে প্রার্থী করেছে। তবে এ সব করে বিজেপির কোনও লাভ হবে না।’’
দু’পক্ষকেই নস্যাৎ করে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘এঁরা নির্বাচনটাকে প্রহসনে পরিণত করছেন! বিজেপিতে মোদী-শাহের কথাতেই সব চলবে, বিধায়কেরা ফালতু। আর তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সব, বাকিদের মূল্য নেই। এটার মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রকে কলুষিত করা হচ্ছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মত, ‘‘অন্যের ঘর ভাঙানোর খেলা শুরু করেছিল তৃণমূল। তখন আমরা বলেছিলাম, এর থেকে তৃণমূলও বাঁচবে না। এ বার বিজেপিও একই কাজ করছে।’’ তাঁদের মতে, ঘরে আগুন দেওয়ার এই রাজনীতিতে পুড়ছে বাংলা।