প্রতিদ্বন্দ্বী: (বাঁ দিক থেকে) শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ এবং শাদাব খান।
পড়ন্ত বিকেলে পটুয়াপাড়ার বস্তির দুয়ারে দুয়ারে হাতজোড় করে তিনি। বিরলকেশ, বয়স ৭৬ ছুঁয়েছে। কিন্তু পায়ের গতি এখনও ত্বরিত। ‘‘পাশের পাড়ায় থাকি। মমতার জায়গায় দাঁড়িয়েছি। একটু দেখবেন, চার নম্বর বোতাম।’’ মুখে আর্জি, সঙ্গে লিখিত আবেদনপত্র।
প্রায় ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবন পেরিয়ে, সাত বার বিধানসভায় জিতে এ বার কি নতুন কেন্দ্রে এসে একটু বেশি খাটতে হচ্ছে তৃণমূলের প্রতীকে প্রথম নির্বাচিত (১৯৯৮ সালে) বিধায়ককে? শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘না, না। আগে রোড-শো করে গিয়েছি এই এলাকায়, কাউন্সিলরেরা ঘুরেছেন। ভাবলাম, নিজেও একটু দেখা করে যাই। চিন্তার কিছু নেই।’’ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে টক্কর নিতে নন্দীগ্রামে প্রার্থী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশের রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে এনে তৃণমূল নেত্রী তাঁর ছেড়ে যাওয়া ভবানীপুরে দাঁড় করিয়েছেন শোভনদেবকে। নেত্রীর দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে এই বয়সেও পরিশ্রমে ঘাটতি রাখছেন না বহু যুদ্ধের পোড়খাওয়া সৈনিক।
প্রার্থী মমতা না থাকতে পারেন, তাঁর নাম আছে, ওজনও আছে। এই ভবানীপুরে শাসক দলের জয় নিয়ে কোনও সংশয় থাকার কথাই নয়। তবু কেন এত ঘাম ঝরাচ্ছেন শোভনদেব, তার কারণটা বোধহয় সংখ্যাতত্ত্বে নিহিত!
পরিবর্তনের ভোটে, ২০১১ সালে ভবানীপুর থেকে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী জিতেছিলেন ৪৯ হাজার ৯০৬ ভোটে। কয়েক মাস পরে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে মমতা সেই ব্যবধান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন ৫৪ হাজার ২১৩-য়। পাঁচ বছর পরে ২০১৬ সালে জোটের প্রার্থী, কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সির বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রীর জয়ের ব্যবধান কমে আসে ২৫ হাজার ৩০১ ভোটে। আর দু’বছর আগের লোকসভা ভোটে বিজেপির চেয়ে তৃণমূলের এগিয়ে থাকার ব্যবধান তিন হাজার ১৬৮। মুখ্যমন্ত্রী নিজে যে পাড়ার বাসিন্দা, সেই ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে ৪৯৬ ভোটে। অর্থাৎ, ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, পাঁচ বছর ধরেই ভবানীপুরে তৃণমূলের দাপট ফিকে হচ্ছে।
শোভনদেবের অবশ্য ব্যাখ্যা, লোকসভা আর বিধানসভা ভোটের পরিপ্রেক্ষিত, মানুষের ভাবনা আলাদা। এই এলাকায় ২০১৪ এবং ২০১৯, দু’বার লোকসভা ভোটেই বিজেপির ফল তুলনায় ভাল। কিন্তু বিধানসভা ভোটে সেই অঙ্ক খাটে না। পাশাপাশি এটাও তিনি বা তৃণমূলের অন্য নেতারা অস্বীকার করেন না যে, ভবানীপুরে অবাঙালি ভোটের পরিমাণ প্রণিধানযোগ্য। এবং সেই ভোটে বিজেপির কামড় ভালই।
অঙ্কের এই সাত-পাঁচ দেখেই বিরোধীরা রব তুলেছে, হারের ভয়ে মুখ্যমন্ত্রী ভবানীপুর ছেড়ে অন্যত্র আসন খুঁজে নিয়েছেন! কেদার বোস লেনে নবনির্মিত বাড়িতে বিজেপির নির্বাচনী কার্যালয়ের চারতলায় বসে রুদ্রনীল ঘোষ যেমন বলছেন, ‘‘ভবানীপুরে পরাজয় নিশ্চিত বুঝে মুখ্যমন্ত্রী পালিয়ে গিয়েছেন! নিজের পাড়াই যাঁকে চায়নি, বাংলা তাঁকে চাইবে কেন?’’ বিজেপি প্রার্থীর আরও বক্তব্য, ‘‘এ বারের ভোটটা ভবানীপুরের বাসিন্দাদের। তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের লড়াই। আমি এখানে প্রতীক মাত্র!’’
‘পালিয়ে যাওয়া’র কথা শুনে বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব হাসছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘আচ্ছা, মমতা দাঁড়ালে হেরে যেত, এটা কেউ বিশ্বাস করে! আমার তো বরং সুবিধা, মমতার তৈরি করে রাখা একটা জমিতে ভোটটা লড়তে নেমেছি! মমতার দূত হয়ে রাসবিহারী থেকে ভবানীপুরে এসেছি।’’
ভবানীপুরে দাঁড়াতে হবে, জানতেন না অভিনেতা রুদ্রনীল। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজের পরিচয়ে ‘ঝন্টুদা’। নিরাপত্তাকর্মীরাও মোবাইল চালিয়ে ‘ঝন্টুদা’র চমৎকারিত্ব দেখেন, কর্তব্য শেষে ফাঁক খুঁজে পুলিশকর্মী তাঁর সঙ্গে নিজস্বী তুলে রাখেন। বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করার পরে এ সবের মধ্যেই ‘ঝন্টুদা’ কিন্তু নতুন চিত্রনাট্য বুঝে নিয়েছেন দ্রুত। বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর টালির চাল। আর এখানে টালির চালের নীচে যে অসংখ্য সত্যিকারের গরিব মানুষের বাস, তাঁদের পানীয় জলের সমস্যা, নিকাশির সমস্যা। বিদ্যুতের সিন্ডিকেট চলে। বিষাক্ত পানীয় জল খেয়ে কয়েক দিন আগে চারটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ সবের জবাব ভবানীপুরের মানুষ এ বার দেবেন।’’
সক্রিয় রাজনীতির ময়দানে নামার পরে কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ হতে হচ্ছে রুদ্রনীলকে। লাল থেকে নীল হয়ে এ বার গেরুয়া হয়েছেন বলে তাঁকে নিয়ে ‘মিম’-এর ছড়াছড়ি! ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে ছয়লাপ সামাজিক মাধ্যমের দেওয়াল। অভিনেতা যদিও এ সব বিশেষ গায়ে মাখছেন না। জানাচ্ছেন, দল করা বলতে যা বোঝায়, প্রথম জীবনে সেটা সিপিএম করেছেন আর এখন বিজেপি। তাঁর মতে, ‘‘এ রকম তো অজস্র লোকই করেছে! কিন্তু মিঠুনদাকে (চক্রবর্তী) নিয়ে আক্রমণ হচ্ছে, রাজকে (পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, রুদ্রনীলের বন্ধু এবং এ বার তৃণমূল প্রার্থী) নিয়েও অনেকে অনেক রকম বলেছে। এক ধরনের টাইমপাস! যাঁরা এ সব বলেন, তাঁদের
পরিবারের সবাই কি সব সময়ে একই দলকে সমর্থন করেন?’’ তাঁর সপাট যুক্তি, মানুষের কাজ করতে গেলে সরকারে যাওয়া দরকার এবং সেই লক্ষ্যেই লড়ছেন। ভবানীপুরে ভোট-ভাগ্য সদয় হলে শহরে হেলথ কিয়স্ক করতে চান, সেই পরিকল্পনাও ভেঁজে ফেলেছেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন আর এক জনও। ভবানীপুর কেন্দ্রের আটটি ওয়ার্ডেই চষে বেড়িয়েছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী শাদাব খান। উড স্ট্রিটের কার্যালয়ে প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভাপতি শাদাব বলছিলেন, ‘‘আমাদের বড় বড় কথা বলার নেই। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ১০ বছর বিধায়ক থাকার পরেও এখানকার নিম্নবিত্ত এলাকাগুলো এমন বেহাল কেন? বিদ্যুৎ, জল, চাকরির ন্যূনতম দাবির কথাই আমরা বলছি।’’
এ রাজ্যে বিদ্যুতের বাড়তি বিল দিতে হয় মানুষকে, এই অভিযোগে যুব কংগ্রেসের হয়ে বার বার আন্দোলনে গিয়েছেন শাদাব। বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেবের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে রুদ্রনীলও বিদ্যুতের দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিদ্যুতের মাসুল নিয়ন্ত্রক কমিশন ঠিক করলেও সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার এক্তিয়ারের কথা মাথায় রেখে সংযুক্ত মোর্চা তাদের ইস্তাহারে বলেছে, ক্ষমতায় এলে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের বিলে ছাড় দেওয়া হবে। বিদ্যুতের দাম রাজ্য সরকার ঠিক করে না জানিয়েও বিদ্যুৎমন্ত্রী এর জবাবে বলে রাখছেন, ‘‘সরকারে ফিরে নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব মানুষকে আরও একটু সুরাহা দেওয়ার।’’
ফিরবে তো তৃণমূলই? ঝিম ধরা দুপুরে পূর্ণ সিনেমার পাশে ছাতুর সরবতের গেলাস হাতে
কালোয়ারি দোকানের কর্মী রমেশ যাদবের মন্তব্য, ‘‘ইস মহল্লা তো টিএমসি কা হ্যায়। লেকিন ইস বার দেখিয়ে...।’’