অনিরুদ্ধ বিশ্বাস ( তৃণমূল ) , অম্বিকা রায় ( বিজেপি )এবং সবুজ দাস ( সংযুক্ত মোর্চা)। কল্যাণী বিধানসভা কেন্দ্রের তিন প্রার্থী।
দেখলি, তোরই তো ছবিতে ভর্তি?
সকাল ১০টা। হালকা আঁচ ছড়াতে শুরু করেছে চৈত্রের আকাশ। কল্যাণী স্টেশনের পাশের রাস্তা দিয়ে ডিসি বিল্ডিংয়ের দিকে চলে যাচ্ছিল বিজেপি প্রার্থী অম্বিকা রায়ের র্যালি। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যিনি প্রশ্নটা করলেন, তাঁর পাশ থেকে উত্তর এল— “ধুর, আমার ছবি কোথায়?”
উত্তরদাতা কমল মণ্ডল এসেছিলেন মদনপুর থেকে কল্যাণীতে চিকিৎসা করাতে। ফেরার ট্রেন ধরতে যাচ্ছেন স্টেশনের দিকে। সামনে দিয়েই যাচ্ছে বিজেপির র্যালি। সেখানেই বড় করে উপস্থিত ‘কমল’, থুড়ি পদ্ম। কিন্তু কমল তখন পাশের বন্ধুকে বোঝাতে ব্যস্ত স্বাস্থ্যসাথীর কী সুবিধা। বুঝতে নারাজ বন্ধু পালটা হাজির করছেন আয়ুষ্মান ভারত। শেষমেশ ট্রেন ধরার তাড়ায় চায়ের কাপটা তাড়াতাড়ি শেষ করে দু’জনেই পা বাড়ালেন স্টেশনের দিকে।
নদিয়ার দক্ষিণ প্রান্তের সাজানো গোছানো শহর কল্যাণী। একেবারে পাশের গয়েশপুর পুরসভা আর আশপাশের কিছু গ্রামীণ এলাকা নিয়ে কল্যাণী বিধানসভা কেন্দ্র। সেই অর্থে খুব পুরনো শহর নয়। আর ডিলিমিটেশনের হাত ধরে রাজ্যের নির্বাচনী মানচিত্রে এই কেন্দ্রের উপস্থিতি সদ্য। এক সময়ে এটি ছিল চাকদহ কেন্দ্রের মধ্যে। আলাদা কল্যাণী কেন্দ্র গঠিত হওয়ার পরে প্রথম বিধানসভা নির্বাচন ২০১১ সালে।
বছর দশেকের সেই কেন্দ্রে মঙ্গলবার সকালে পা রেখে ভোটের উত্তাপ টের পাওয়া গেল। সকাল সাড়ে ৮টায় তখন ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে শহর। স্টেশন এবং বাজার লাগোয়া এলাকায় চেনা ব্যস্ততার ছবি। ১ নম্বর মার্কেট এলাকায় চায়ের দোকানে মন দিয়ে মোবাইলে চোখ বোলাচ্ছেন এক মধ্যবয়স্ক। তাঁকেই আলাপির জিজ্ঞাসা, “খেলা হচ্ছে নাকি, দাদা?” হালকা হাসি জবাব ফেরাল, “খেলা কি হচ্ছে বুঝছি না, তবে ভোট হচ্ছে দাদা। আমরা তো দর্শকমাত্র।”
হাতে ধরা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের পর্দায় তখন ভেসে উঠছে খবরের চ্যানেলে তৃতীয় দফার ভোটের চিত্র। “দর্শক কেন, আমজনতাই তো রেফারি বা আম্পায়ার যা-ই বলুন।” জবাব এল, “সে আর মানছে কে বলুন? খেলছে তো নিজেদের মতই।”
বাইরে রোদ চড়ছে। একদা শিল্পনগরীর দেওয়ালেও সেই ‘খেলা হবে’, ‘সোনার বাংলা’ আর ‘তৃতীয় বিকল্প’-এর তুল্যমূল্য লড়াই। তাঁর আচ পৌঁছেছে গ্রামীণ কল্যাণীতেও। সগুনা লিচুতলার কাছে মদনপুরগামী রাস্তার ধারে গাছতলায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন জনা কয়েক। কান পেতে শোনা গেল— “কেন্দ্রীয় বাহিনী আসছে, খেলা আর হল না মনে হয় তোদের।” আলতো টোকায় কথাটা ছুড়ে দিয়ে মুচকি হাসছেন এক যুবক। পাশের জন প্রায় তেড়েই এলেন, “আরে, একটা দলকে হারাতে দিল্লি থেকে এত বড় নেতাদের ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে হচ্ছে এখানে। সেটা আবার কী খেলা?” সামনেই ব্যানারে হাজির সিপিএমের সবুজ দাস, তৃণমূলের অনিরুদ্ধ বিশ্বাস। দ্বিতীয় জন তখনও বলে চলেছেন, “আর তোরাও তো সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা নিচ্ছিস!” প্রথম জনের পাল্টা, “কত জন স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা পেয়েছে, দেখিয়ে দে। তোর চেনা আছে?”
সামনের রাস্তা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছিল একটা সাইকেল। আড্ডা থেকে ডাক গেল— “কী রে, তোদের মিছিল কবে?” মিছিল রোজই হচ্ছে। আড্ডার ইঙ্গিত পেয়ে সাইকেল নিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে এলেন আরোহী। “লড়াই কিন্তু হবে বুঝলি এ বার”, বলে তিনি গুছিয়ে বসতে যেতেই প্রথম জন বলে উঠলেন, “লড়াই ফড়াই বুঝি না! সোনার বাংলা হবে। এখানকার শিল্পাঞ্চলের তোরা কী হাল করেছিলি, মনে আছে?” সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে ফোড়ন, “হ্যাঁ, তোদের আমলে তো খুব উন্নতি হয়েছে শিল্পাঞ্চলের!”
দু’জনের কথার লড়াইয়ের মাঝে তখন ফের মুচকি হাসছেন প্রথম জন, “তোরা নিজেরাই তো বলে দিচ্ছিস যে তোরা কিছুই করিসনি। সেই জন্যই তো সোনার বাংলা গড়ার লড়াই আমাদের।” বাকি দুজন রে-রে করে ওঠেন, “সব বিক্রি করে কী দেশ গড়ছিস, সে তো দেখছিই। আর সোনার বাঙলা গড়ে কাজ নেই তোদের!”
ফিরতি পথে শিল্পাঞ্চলের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে এক জন পাশের কানে গুনগুনান— “যে যাই বলুক, সিপিএমের সবুজ কিন্তু লড়াইয়ে আছে।” মনে পড়ে গেল, সকালেই কল্যাণী স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে কমল মণ্ডলের স্বগতোক্তি, “যেখানে লাল দলের প্রার্থীর নামই সবুজ, সেখানে আমার আর নামের দোষ কী!”