ফিরহাদ হাকিম, মহম্মদ মোক্তার এবং বোধকিশোর গুপ্ত।
প্রকাশ্যে ‘মিনি পাকিস্তান মন্ত্রী’ নাম দিয়ে বিজেপি তাঁর দিকে প্রশ্ন ছোড়ে। আবার তাঁর মণ্ডপে দেবীর চক্ষুদান করে ফি-বছর শারদোৎসবের সূচনা করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।
শুধু এই একটিই নয়। এমন অসংখ্য বৈপরীত্য নিয়েই গত এক দশক ধরে রাজ্যের রাজনীতি-চর্চায় অপরিহার্য ফিরহাদ হাকিম। এ বারের নির্বাচনে সেই ফিরহাদ কতটা নিশ্চিন্ত তাঁর কেন্দ্র কলকাতা বন্দরে? বাবুবাজারের মুখে প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে গিয়েছিলেন তরুণ। হিন্দি মেশানো বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ববিদা? তার পরে বললেন, ‘‘হ্যাঁ, জিতে যাবেন। প্রত্যেক বার অনেকে অনেক কিছু বলে যায়। আসলে ও ঠিক ‘পাড়ার ছেলে’।’’
ছেলে কোথায়? চুলে পাক ধরেছে। চেহারা ভারী হয়েছে। কিন্তু এখনও নিজের কর্মজগতে এই রকম একটা ছোকরা ইমেজ বেঁচে আছে ববির। সেই ইমেজেই বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রে ছুটে বেড়াচ্ছেন ফিরহাদ। তাঁর কথায়, ‘‘জিতব। তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আমি লড়ছি আমার সঙ্গে। ভাবি, কেন এই কেন্দ্রের ১০০ শতাংশ মানুষ আমাকে ভোট দেন না? কেন আমি সকলের কাছে পৌঁছতে পারি না?’’
রাজনীতিতে হাতেখড়ি কলকাতা পুরসভায়। ক্লাব, হাসপাতাল আর শ্মশান করে বেড়ানো সেই ছোকরা রাজনীতিক অবশ্য কাউন্সিলর থেকে কলকাতার মেয়র হয়েছেন। বিধায়ক হয়েছেন। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীও। এত ওজনদার অলঙ্কার যুক্ত হয়েছে ফিরহাদের রাজনৈতিক জীবনে।
কিন্তু প্রার্থী হিসেবে নিজের কেন্দ্রে কেমন? তাঁরই বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর রঞ্জিত শীল তো জবাবে বললেন, ‘‘কাজ করেছেন প্রচুর। রাস্তা, আলো। তা ছাড়া, মন্ত্রী হলেও এলাকার মানুষের যোগাযোগের বাইরে চলে যাননি। বিধায়ক হিসেবে পাওয়া যায়।’’
২০০৯ সালে প্রথম উপনির্বাচনে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন ফিরহাদ। তখন ছিলেন আলিপুরের বিধায়ক। তার পরে আসন বদলে তিনি আসেন গার্ডেনরিচে। সেই আসনই ২০১৬ সাল থেকে কলকাতা বন্দর।
মিশ্র আর্থ-সামাজিক গঠন এই কেন্দ্রের। একাংশে সাজানো উচ্চবিত্ত, আবার ঠিক উল্টো ছবিও রয়েছে বড় অংশ জুড়ে। শেষ বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট ছিল ৫৩ শতাংশ। আর লোকসভা নির্বাচনে এই বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থীর ভোট বেড়ে হয়েছিল ৫৭ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে বিজেপি উঠে এলেও এখানে তৃণমূল এগিয়ে ছিল ৩৬ হাজার ভোটে। সে দিক থেকেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারে তৃণমূল।
কারণ, বাকি অর্ধেকের ভাগাভাগিতেই কি বিরোধীরা কাত? বন্দর অঞ্চলের রাজনীতির আরও এক পুরনো ‘যোদ্ধা’, সংযুক্ত মোর্চার কংগ্রেস প্রার্থী মহম্মদ মোক্তার বলছেন, ‘‘মন্ত্রী তো নিজের এলাকার জন্য কিছুই করেননি। কাজ নেই, রোজগার নেই। সব কিছুতে কাটমানি আর তোলাবাজি দিয়ে এ বার আর হবে না। একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হয়েছে। সেখানেও ভর্তি হতে টাকা লাগে।’’
ভোটের এই অঙ্কে এখানে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাম-কংগ্রেস জোটের ভোটও ছিল ৩৪ শতাংশের মতো। কংগ্রেসের আর এক শক্তিশালী নেতা রাকেশ সিংহ বামেদের সমর্থনে সে বার দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। তাতে তাঁর ব্যক্তিগত শক্তিও ছিল। রাকেশ এখন কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে। তবে নির্বাচন শুরুর ঠিক আগেই মাদক মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। ফিরহাদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন অবোধকিশোর গুপ্ত। ২০১৬ সালে প্রার্থী হয়ে বিজেপির ঘরে তিনি ভোট টানতে পেরেছিলেন মাত্র ৯ শতাংশ। তবে রাকেশ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে লোকসভা ভোটে তাদের সেই ভোট বেড়ে হয়েছে ৩২ শতাংশ। অবোধের সহজ হিসেব, ‘‘রাকেশের ভোট বিজেপির ঝুলিতে চলে আসবে। আর সংখ্যালঘু ভোটও দু’তিন ভাগ হয়ে যাবে। তাই এ বার বিজেপির জয় নিশ্চিত।’’
সেই সঙ্গে মেরুকরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও দাবি করছেন বিজেপি প্রার্থী। বলছেন, ‘‘এই যে বিজেপির নামে গাল দিচ্ছেন, ‘মিনি পাকিস্তান’ করবেন বলছেন। এ সবে হিন্দু ভোট এক জায়গায় হয়ে যাবে।’’ এ বারের ভোটে এই প্রচারের মুখে পড়ে ‘মহাভারত’ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন ফিরহাদ। বলছেন, ‘‘শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, কর্মই ধর্ম। আমি হিন্দু-মুসলমান ভাবি না। ভাবি, কাজ করে যেতে হবে।’’ মমতার এখনকার ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ ফিরহাদ বলছেন, ‘‘আমাকে মুসলমান হিসেবে দেগে দিতে মিনি পাকিস্তানের মতো একটা মিথ্যা প্রচার করছে বিজেপি। আমার জন্ম এ মাটিতে, কবরও হবে এ মাটিতে। এই দেশ আমার সর্বশ্রেষ্ঠ।’’
বন্দর লাগোয়া বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসকদলের প্রশ্রয়ে গা-জোয়ারি, বেআইনি নির্মাণ নিয়ে বিরোধীরাই শুধু নয়, কানাকানি করেন সাধারণ মানুষও। এবং স্থানীয় বিধায়ক হিসেবে আঙুল ওঠে সেই ফিরহাদের দিকেই। এই বিধানসভা কেন্দ্রেরই তৃণমূলের আর এক বিদায়ী কাউন্সিলর অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘ঘটনা কিছু আছে। কিন্তু আমরা বেআইনি নির্মাণ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও করেছি।’’