অদ্রীশ বেজ এবং স্মৃতি চক্রবর্তী
ভোটের দিকেই তাকিয়ে সবাই। তাকিয়ে ভোটের ফলের দিকে। শুধু রাজ্যের কিছু পরিবার তাকিয়েছিল একটা ঘোষণার দিকে। কেন্দ্রের তরফে ‘রেয়ার ডিজ়িজ় পলিসি’-র ঘোষণা। যদি সেই নীতি ঘোষণার পরে একটু নড়েচড়ে বসে এ রাজ্যের সরকার। যদি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার বদলে অন্তত কিছুটা চিকিৎসার সুযোগ পায় ওই সব পরিবারের রুগ্ন সন্তানেরা! কিন্তু অপেক্ষাই সার! ছবিটা বদলাল না।
শিলিগুড়ির স্মৃতি চক্রবর্তী, পশ্চিম মেদিনীপুরের অর্চিষ্মান মুখোপাধ্যায়, রূপসা মুখোপাধ্যায়, হুগলির সৌমাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ব মেদিনীপুরের অদ্রীশ বেজ-রা খবরের কাগজে-টিভিতে দেখছে— করোনার প্রতিষেধক এসে গিয়েছে। আর তা নেওয়ার হুড়োহুড়ি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে। ওরা দেখছে ‘ভোট উৎসব’ ঘিরে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হওয়ার ছবিও। ওদের কারও ক্লাস থ্রি, কারও ফাইভ। কেউ বা টু-এর পর আর স্কুলে ঢোকার সুযোগই পায়নি। লকডাউনের অনেক আগে থেকেই সম্পূর্ণ অন্য কারণে ওদের স্কুল যাওয়া বন্ধ। এখন বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা ওদের বাড়িও আসছেন ভোট চাইতে। আর ওরা ভাবছে, এ বার কি তা হলে ওদের কথাও কেউ ভাববে? বিছানা ছেড়ে আর পাঁচ জনের মতো বাইরের জগৎটা কি দেখার সুযোগ জুটবে ওদের? স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি-তে আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবারের কাছে এর চেয়ে বড় প্রশ্ন আর কিছু নেই।
জিনঘটিত এই বিরল রোগে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ একে একে বিকল হতে শুরু করে। ক্রমশ চলচ্ছক্তি হারিয়ে যায়। চিকিৎসার খরচ এতটাই যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা জোগাড় করা সম্ভব হয় না পরিবারের পক্ষে। চোখের সামনে সন্তানের পরিণতি দেখা ছাড়া কার্যত আর কোনও পথ থাকে না। ২০১৭ সালে ‘রেয়ার ডিজ়িজ় পলিসির’ খসড়া তৈরি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। প্রাথমিক ভাবে ১০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি হয়। স্থির হয়, ৬০-৪০ অনুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে খরচ হবে। ঠিক করা হয়, স্টেট টেকনিক্যাল কমিটি গড়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করতে পারবেন বিরল রোগে আক্রান্ত বা তাদের পরিবারের লোকেরা। কিন্তু এই নীতি বাতিল হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে নতুন নীতি চূড়ান্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়নি। বিভিন্ন আদালতে এ নিয়ে কয়েকটি মামলাও চলছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল, ২০২১-এর ৩১ মার্চের মধ্যে বিরল রোগ সংক্রান্ত সরকারি নতুন নীতি ঘোষণা হবে। তার পর থেকেই শুরু প্রতীক্ষা। যদি এসএমএ আক্রান্তদের জন্য সরকারি মনোভাবের কিছুটা বদল হয়! কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এ বারেও সরকারি তালিকায় ঠাঁই পেল না এই রোগ। চিকিৎসার খরচ খুবই বেশি এবং চিকিৎসার ফলাফল সংক্রান্ত গবেষণা খুবই কম- এই কারণ দেখিয়ে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর পরামর্শ দিয়েই দায়
সারল সরকার।
কী অবস্থা এ রাজ্যের? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, বিরল রোগ সংক্রান্ত একটা কমিটি তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তা নামমাত্র। দুটো মাত্র বৈঠক ছাড়া এ যাবৎ সেই কমিটির কোনও কাজ সামনে আসেনি। দ্বিতীয় ও শেষ বৈঠকটি হয়েছিল ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, বিরল রোগের বিষয়টি তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, যে সব বিরল রোগের এককালীন চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যে সব রোগের চিকিৎসা নেই। এবং তৃতীয়ত, যে সব রোগের চিকিৎসা আছে, কিন্তু তা খুবই খরচসাপেক্ষ। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, এসএমএ রোগীদের পরিবারের তরফে বার বার আবেদন জমা পড়েছে এ কথা ঠিক। এক বার ভাবাও হয়েছিল, অন্তত কয়েকটি শিশুকে সুস্থ জীবনে ফেরানোর জন্যও যদি কিছু করা যায়! কিন্তু তার পরে বিষয়টা আর বেশি দূর এগোয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষণা র জন্য অপেক্ষা ছিল। এখন তো আর বিশেষ কিছু করার নেই। পরবর্তী স্তরে কেন্দ্রীয় সরকার আর কোনও ঘোষণা করে কি না দেখা যাক।’’
কিন্তু দুরারোগ্য অসুখের ছড়িয়ে পড়া কি কেন্দ্রের নীতির জন্য অপেক্ষা করে? ২০১৪ সালে কয়েকজন এসএমএ আক্রান্ত শিশুর বাবা-মা তৈরি করেছিলেন ‘কিয়োর এসএমএ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’ নামে একটি সংগঠন। এর মধ্যে একাধিক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের হারিয়েছেন। সংগঠনের তরফে মৌমিতা ঘোষ বলেন, ‘‘যত দেরি হচ্ছে, রোগ তো তত ছড়িয়ে পড়ছে। যে বাচ্চাটা হয়তো সামান্য হাঁটাচলা করতে পারত, বিনা চিকিৎসায় পড়ে থেকে থেকে ক্রমশ তারও নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষণার পর তো নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ সেই তিমিরেই। চিকিৎসা আছে, কিন্তু তা পাওয়ার আশা নেই।’’
শিলিগুড়ির বাসিন্দা স্মৃতি চক্রবর্তীর বয়স ১২ বছর। মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে। অস্ত্রোপচার দরকার। চলাফেরা করতে পারে না। খাওয়ার সময়ে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিতে হয়। স্মৃতির মা লিপিকা চক্রবর্তী পরিচারিকার কাজ করেন। সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব তাঁর একার উপরেই। চিকিৎসা করাতে পারছেন না। বললেন, ‘‘চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হতে দেখা যায় না। ওদের কথা কেউ একটু ভাবুক, আর কিছু চাই না।’’
শুধু ওষুধ নয়, এসএমএ আক্রান্তদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার উপশমের জন্যও সরকারি স্তরে আলাদা ব্যবস্থা নেই। যেমন, স্নায়ু সংক্রান্ত সমস্যায় বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস-এ গেলে তাদের জন্য পৃথক কোনও বন্দোবস্তই নেই। মৌমিতা বলেন, ‘‘আমাদের বাচ্চারা কি ও ভাবে লাইনে দাঁড়াতে পারে? ওদের কথা কেন কেউ ভাববে না? কোয়ালিটি অব লাইফ বলে কি ওদের কিছু থাকতে পারে না?’’ কান্নায় বুজে আসে তাঁর গলা।
স্রেফ টাকার অভাবে ঝরে যাচ্ছে একটা একটা করে প্রাণ। অথচ এসএমএ নামে যে অসুখ আছে, স্বাস্থ্য ভবনের অধিকাংশ ঘরে তার খবরই নেই।