অবহেলা: আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে দেখেও মিছিলে রাশ টানেনি কোনও দলই। নিজস্ব চিত্র।
ক্ষুব্ধ, হতাশ, অসহায়! সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মানসিক অবস্থা এখন এমনই।
কারণ? দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার অভাব।
অনেকের মতে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনের সময়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, সেটা এক দিক থেকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’। কারণ, নীতিগত ভাবে কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় সব থেকে আগে থাকা উচিত নাগরিকদের জীবনের সুরক্ষার বিষয়টি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ এ দেশের চিত্রটা পুরোপুরি বিপরীত। এখানে নির্বাচনে জয়লাভই একমাত্র লক্ষ্য। তার জন্য মিছিল, সমাবেশের আয়োজন করে, হাজার-লক্ষ লোকের জমায়েত করে ‘দল কতটা শক্তিশালী’, তা প্রমাণেরই নিরন্তর প্রচেষ্টা চলেছে। যার জেরে সংক্রমণের থাবা ক্রমশ বাড়তে থাকছে। আর নাগরিকেরা হারাতে থাকছেন পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব-প্রিয়জনেদের।
এমনিতেই বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড গর্ভন্যান্স ইন্ডিকেটরস’ (ডব্লিউজিআই) বা ‘বিশ্বব্যাপী শাসনপদ্ধতি সূচক’-এর ছ’টি মাপকাঠির মধ্যে অন্যতম মাপকাঠি, ‘ভয়েস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ বা ‘জনমত ও দায়বদ্ধতা’ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা, গণতন্ত্র নিয়ে জনসাধারণের সন্তোষ-সহ একাধিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই মাপকাঠিতে ২০১৯ সালে (সর্বশেষ রিপোর্ট) ১০০-র মধ্যে ভারতের স্কোর ছিল ৫৭.৬৪। এক গবেষকের কথায়, ‘‘ডব্লিউজিআই প্রকাশ করলেও বিশ্ব ব্যাঙ্কের তরফে বলা হয়, এটা তাদের মত নয়। তা হলেও এই সূচকের মাধ্যমে সার্বিক ভাবে দেশগুলির গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার একটা আভাস পাওয়া যায়।’’ এক সমাজতাত্ত্বিকের কথায়, ‘‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপরেই শাসন-পরিচালনা নির্ভর করে। কিন্তু করোনাভাইরাস দেখাল যে, সেই নেতৃত্ব কতটা অন্তঃসারশূন্য।’’
আর অন্তঃসারশূন্য বলেই করোনা সংক্রমণ রয়েছে জেনেও যাবতীয় বিধিনিষেধ, সতর্কতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মিছিল, সমাবেশের আয়োজন করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ওয়ার্ল্ড সোসাইটি অব ভাইরোলজি’-র প্রেসিডেন্ট এবং ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’-র এমেরিটাস বিজ্ঞানী অনুপম বর্মা রীতিমতো ক্ষুব্ধ স্বরেই বলছেন, ‘‘শুধুমাত্র নির্বাচনে জিততে, দলীয় শক্তি প্রদর্শনে এ ভাবে জমায়েত অপরাধের শামিল!’’ আর এক ভাইরোলজিস্টও একই সুরে বলছেন, ‘‘জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও ভোটারদের কাছে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা ভোট চাইতে যাচ্ছেন নির্লজ্জ ভাবে। আর সংক্রমণের শিকার তো শুধু সাধারণ মানুষই নন, নেতা-নেত্রীরাও তো হচ্ছেন। তাঁরাও প্রিয়জনেদের হারাচ্ছেন। সেখানে ভোটটাই কী ভাবে শেষ কথা হতে পারে?’’
নির্বাচনী প্রচার কী ভাবে সংক্রমিতের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে, তার পরিসংখ্যানগত ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন গবেষকদের একাংশ। এ ক্ষেত্রে তাঁরা মাসের প্রথম তারিখ, ১৫ তারিখ ও শেষের তারিখের হিসেব দিচ্ছেন। যেমন ১, ১৫ ও ৩১ জানুয়ারি রাজ্যে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল (দৈনিক ভিত্তিতে) যথাক্রমে ১১৫৩, ৬২৩ ও ২২৯ জন। ১, ১৫ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৭৯, ১৩৩ এবং ১৯২ জন। ১, ১৫ ও ৩১ মার্চ ওই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯৮, ২৫১ এবং ৯৮২। যা আচমকাই বাড়ে চলতি মাসে।
এক জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, মিছিল, সমাবেশের দরুণ সংক্রমিতের সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টি মার্চ থেকেই নজরে এসেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার পরেও রাজনৈতিক দলগুলি প্রচারের ক্ষেত্রে কোনও রকম নিয়ম-নীতি মানার তোয়াক্কাই করেনি। তাঁর কথায়, ‘‘এখন এসে অনেকে করোনা সতর্কতার কথা বলছেন বটে। কিন্তু এখন আর বলে কী লাভ? এত দিনে যা ক্ষতি হওয়ার তো হয়ে গিয়েছে।’’ যার ফলে ১ ও ১৫ এপ্রিল রাজ্যে সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১২৭৪ ও ৬৭৬৯ জন। যা বুধবার বেড়ে (দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা) দাঁড়ায় ১০,৭৮৪-তে। বৃহস্পতিবারএক দিনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৯৪৮ জন।
মাইক্রোবায়োলজিস্ট বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘আজকের এই পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলি ষোলো আনা দায়ী। এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তারা ন্যূনতম দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়নি। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক!’’
দুর্ভাগ্যই বটে। যে কারণে ‘জনমত ও দায়বদ্ধতা’-র মাপকাঠিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ৬০-এর মানও পেরোতে পারে না!