মেয়েদের স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র থেকে গার্হস্থ্য— ভোটের ইস্তাহারে হয়তো ঠাঁই পায়, কিন্তু বাস্তবে?
West Bengal

bengal polls: ‘সেই সরকার চাই, যার রাজত্বে পিঠের ব্যাগ বুকে নিতে হবে না’

রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারে রয়েছে এমন হরেক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু পথেঘাটে মেয়েদের সুরক্ষা? লিঙ্গ-বৈষম্য? নারী-নিগ্রহ? 

Advertisement

স্বাতী মল্লিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২১ ০৫:২৯
Share:

প্রতীকী চিত্র।

স্বামী অত্যাচার চালাত প্রায়ই। লকডাউনে তার মাত্রা বাড়ে বহু গুণ। এক দিন মারধর এতটাই চরমে ওঠে যে, শিশুকন্যাকে নিয়ে শুনশান পথে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে আট-দশ কিলোমিটার পথ হেঁটে অবশেষে মা-বাবার বাড়িতে পৌঁছন ওই মহিলা।

Advertisement

লকডাউন বা তার পরবর্তী সময়ে এ রাজ্যে নারী নির্যাতনের ‘মুখ’ এই মহিলাই। অথচ, ভোটমুখী বঙ্গে মেয়েদের এই গার্হস্থ্য সমস্যা কী ভীষণ অবহেলিত ও উপেক্ষিত।

সরকারি চাকরিতে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ, ন্যূনতম মাসিক আয় খাতে বছরে ৬০০০ টাকা পরিবারের কর্ত্রীর হাতে দেওয়া, মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে পরিবহণ, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবা— রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারে রয়েছে এমন হরেক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু পথেঘাটে মেয়েদের সুরক্ষা? লিঙ্গ-বৈষম্য? নারী-নিগ্রহ?

Advertisement

ভোটের আগে সিপিএমের ইস্তাহারে এই প্রসঙ্গ ঠাঁই পেলেও পদ্ম বা ঘাসফুল শিবির— কারও ইস্তাহারেই এর উল্লেখ নেই। অথচ বাস্তব বলছে, এ রাজ্যে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গার্হস্থ্য হিংসা ও নারী নিগ্রহে দেশের মধ্যে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং চতুর্থ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। জাতীয় মহিলা কমিশনের দাবি অনুযায়ী, গার্হস্থ্য হিংসা ও মহিলাদের উপরে অত্যাচারের সংখ্যা, মাত্রা এবং সুযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে লকডাউনে। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার অনুরাধা কপূর জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে বহু মেয়ের জীবনেই বিভীষিকা এনে দিয়েছে লকডাউন। তাঁর কথায়, ‘‘কর্মহারা, ঘরবন্দি মানুষ উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা-হতাশা থেকেই রাগ উগরে দিয়েছে স্ত্রীর উপরে। হস্টেল বা বাইরে থেকে কমবয়সি মেয়েরাও লকডাউনে বাড়ি ফিরে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছে।’’ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ও মনে করছেন, লকডাউন হিংস্রতা বাড়িয়েছে, মানসিকতা পাল্টেছে, মানুষকে আরও অসহিষ্ণু করেছে। সে সময়ে আদালত-হোম-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি বন্ধ থাকায় ন্যূনতম সাহায্যও পাননি নিগৃহীতারা। পুলিশও অনেক সময়ে পাশে দাঁড়াতে পারেনি।

যদিও হাইকোর্টের আইনজীবী কল্লোল মণ্ডল জানাচ্ছেন, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মেয়েরা স্থানীয় থানায় গিয়ে বা ইমেলে অভিযোগ জানাতেই পারেন। সাড়া না-পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থও হতে পারেন। এ ছাড়া, রয়েছে মহিলা কমিশনও। ‘প্রোটেকশন অব উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ (২০০৫)-এর অধীনে কোর্টে যেতে পারেন মেয়েরা। সে ক্ষেত্রে খোরপোশ, স্বাস্থ্য খাতে খরচ, বাসস্থানের খরচ, ক্ষতিপূরণ, আদালতের খরচ, সন্তানের হেফাজত-সহ একাধিক সুবিধা পাবেন নিগৃহীতা।

পথেঘাটে নারী সুরক্ষার ছবিটাও তথৈবচ। কামদুনি থেকে কাটোয়া, পার্ক স্ট্রিট থেকে বানতলা— একের পর এক ঘটনাই প্রমাণ করে, আজও কতটা অসুরক্ষিত মেয়েরা। তাই তো এখনও আধো-অন্ধকার গলিতে কোনও পুরুষের হাত আচমকা ছুঁয়ে যায় তরুণী শিক্ষিকার শরীর। বাসে-ট্রেনে কদর্য ইঙ্গিতের মুখোমুখি হন কলেজছাত্রী। রাতের শহরে স্কুটার চালিয়ে ফিরতে গিয়ে কটূক্তি শুনতে হয় জনৈক মহিলা চিকিৎসককে। ‘‘স্কুটার চালিয়ে ফেরার সময়ে তিন-চারটি বাইকে করে অনুসরণ করা, পাশাপাশি যেতে যেতে অশালীন মন্তব্য করা— এমন কয়েক বার হয়েছে। হায়দরাবাদ-কাণ্ডের পরে রীতিমতো আতঙ্ক হয়।’’— অকপট ওই চিকিৎসক।

এই অবস্থার জন্য রাজ্যে পরিকাঠামোর অভাবের দিকেই আঙুল তুলছেন অনেকে। অধ্যাপিকা-সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষের মতে, সুবিচার তো পরের কথা। কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা কী ভাবে আটকানো যায়, সে দিকেই নজর নেই কারও। মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে তাঁদের দক্ষতা বাড়ানো ও ভিন্ন পেশায় সুযোগ দেওয়া, সুরক্ষা বাড়াতে বাজেটে পরিকাঠামোগত বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং তার রূপায়ণ, দোষীকে শাস্তি দেওয়া— ভোটপর্বেও এ সব কথা ব্রাত্য। শাশ্বতী বলছেন, ‘‘শুধু ইস্তাহারে উল্লেখ করা বা না-করায় নারী নিগ্রহ আটকাবে না। পুলিশ-প্রশাসনকে পাশে দাঁড়াতে হবে। অপরাধীকে কঠোর সাজা দিতে হবে, যাতে বার্তা যায় যে, নিগ্রহ করে পার পাওয়া যাবে না।’’ আবার অনুরাধার মতে, ‘মেয়েদেরই মানিয়ে নিতে হবে’— সমাজের সর্বস্তরে এই মানসিকতার বদল জরুরি। প্রয়োজন স্কুল-কলেজে সচেতনতার প্রচারও।

তবে নারী-নিগ্রহ এড়াতে পরিবার ও একটি মেয়ের ভূমিকাও যে কম নয়— তা মনে করাচ্ছেন লীনা। তাঁর মতে, একটি পরিবার মেয়েকে স্বাবলম্বী করে তুললে এবং সেই মেয়ে যথেষ্ট সচেতন ও প্রতিবাদী হলে প্রথম দিনই রুখে দাঁড়াতে পারবে। লীনার সাফ কথা, ‘‘সারা বছর ধরে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করলে সেটাই আখেরে কাজে দেবে। নারী-সুরক্ষা তো জীবনের অঙ্গ, তাকে আলাদা করে ভোটের সময়ে তুলে ধরতে হবে কেন? ইস্তাহারে নারী নির্যাতনের উল্লেখ তো এক ধরনের চমক মাত্র!’’

তাই তো ভোটযুদ্ধের প্রাক্কালে ফেসবুকে পোস্ট দেন জনৈক তরুণী— ‘সেই সরকার চাই, যার রাজত্বে পিঠের ব্যাগ বুকে নিতে হবে না’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement