ভোটের ময়দানে নারীরা। —ফাইল চিত্র
‘‘রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের আক্রমণ করা সব থেকে সহজ। কারণ রাজনীতি তো পুরুষের আঙিনা! পারিবারিক সূত্রে উচ্চ বংশের কেউ রাজনীতিতে এলে তবু তা মানিয়ে নেয় সমাজ। কিন্তু রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নেই, এমন কোনও নারী রাজনীতিতে নামলে তাঁকে কদর্য আক্রমণের সামনে পড়তে হবেই।’’ —বলছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা শমিতা সেন। প্রসঙ্গ— রাজনীতির আঙিনায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব এবং তাকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক তরজায় কুকথার বর্ষণ।
বিষয়টি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে শুক্রবার রাজ্যের শাসক দলের তরফে আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরে। তথ্য বলছে, ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকায় মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন ৩১ জন, ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ জন। আর এ বার তা আরও বেড়ে হয়েছে ৫০ জন।
কিন্তু তাই বলে কি নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে?
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এখনও ‘রাজনীতি পুরুষেরা করবেন, নারীদের সেখানে ভূমিকা কী’— এই দৃষ্টিভঙ্গিই দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রাধান্য পায়। ‘ইকনমিক সার্ভে’ অনুযায়ী, দেশের ৬০ শতাংশ কর্মক্ষম মহিলা (১৫-৫৯ বছর বয়সি) পুরোপুরি ভাবে ঘরকন্নার কাজেই নিয়োজিত থাকেন। যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। যেখানে রাজ্যের ২৯৪টি আসনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মাত্র ৪০ জন (২৯ জন তৃণমূলের, ছ’জন বাম ও সহযোগী দলগুলির, চার জন কংগ্রেসের আর এক জন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার) ছিলেন মহিলা বিধায়ক।
নারী-পুরুষের এই বিভাজন বা লিঙ্গবৈষম্য যে জাতিগত, ধর্মগত বা শ্রেণিগত বৈষম্যের থেকেও তীব্র মাত্রার— এমনটা মনে করছেন অনেকেই। ‘‘আসলে পিতৃতন্ত্র একটি মনোভাব। এক জন পুরুষ নারীদের জীবনের অভিজ্ঞতা যাপন না করেও নারীবাদীমনস্ক হতে পারেন। তেমনই এক জন নারী হতে পারেন পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধি। কোনও নারী নিজেকে পিতৃতন্ত্রের প্রতিনিধি ভাবা শুরু করা মাত্রই অন্য নারীকে পুরুষদের মতোই অশালীন আক্রমণ করেন।’’—বলছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর ডিন তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রদীপ বসু।
যে অশালীন আক্রমণের মাত্রা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বছর তিনেক আগে ‘ইন্টারন্যাশনাল সামিট অন ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন ইন পলিটিক্স’ ও ‘ওয়েস্টমিনিস্টার ফাউন্ডেশন ফর ডেমোক্র্যাসি’-র রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে বিশ্বের দেশগুলির সংসদীয় প্রতিনিধির মধ্যে ২৩ শতাংশ হলেন মহিলা প্রতিনিধি, যা অতীতের তুলনায় বেশি। কিন্তু রিপোর্ট এ-ও বলছে, রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে তাঁদের বিরুদ্ধে হিংসার পরিমাণও বেড়েছে। আভিধানিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন ইন পলিটিক্স’ (ভিএডব্লিউপি)।
আর এই ‘ভিএডব্লিউপি’-র মাপকাঠিতে অন্যতম হিংসা হল মানসিক হিংসা (সাইকোলজিক্যাল ভায়োলেন্স), যার মাধ্যমে পরিকল্পিত ভাবে মৌখিক, আবেগজনিত আক্রমণ, শারীরিক কটূক্তির একটি আক্রমণের ধারা তৈরি করা হয়। যার একটাই উদ্দেশ্য— রাজনীতির পাঁকে তিনি থাকতে পারবেন না কি পারবেন না, এক জন মহিলা প্রার্থীর মনে এই আত্মসঙ্কট তৈরি করা। আর সোশ্যাল মিডিয়া এই ধরনের আক্রমণের অন্যতম হাতিয়ার।
নারী অধিকার-কর্মী তথা অর্থনীতির অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বলছেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় কদর্য আক্রমণের পিছনে যে মানসিকতা কাজ করে তা হল, মেয়েরা রাজনীতি বোঝে না। ওরা শুধু ধর্ষণ আর গার্হ্যস্থ হিংসাই বোঝে। এই মানসিকতার মাধ্যমে আসলে নারীদের বিচারবুদ্ধির ক্ষমতাকে হেয় করা হয় সচেতন ভাবে।’’
‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর রিপোর্ট বলছে, ভারতীয় মহিলা রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে দিনে গড়ে ১১৩টি ‘অস্বস্তিকর’ বা ‘কদর্য’ টুইট ব্যবহার করা হয়। প্রতি সাত জন মহিলা রাজনীতিকের মধ্যে এক জন মহিলা এই কদর্য টুইটের শিকার। যে রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ঘুরে আসতে হয় সেই ইতিহাসের অধ্যাপিকা শমিতাদেবীর কথাতেই—‘‘নারীরা যদি পুরুষের শর্ত মেনে রাজনীতি তথা সামাজিক আঙিনায় আসেন, তা হলে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু নারীরা নীতিগত ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেই সমস্যা শুরু হয়।’’
রাজ্যে ক্ষমতাসীন শাসক দলের প্রার্থী তালিকায় ৪৫ জন থেকে ৫০ জন মহিলা প্রতিনিধিতে উত্তরণ সেই সমস্যার সমাধান করতে পারবে কি? সেটাই এখন প্রশ্ন!
(চলবে)