প্রথম বার ভোট দিতে এসেই পিঠ ফুঁড়ে দিয়ে গেল গুলি। শীতলখুচিতে নিহত আনন্দ বর্মণ (১৮)। নিজস্ব চিত্র
ভোটের ফলে প্রত্যাবর্তন বা পরিবর্তন যা-ই ঘটুক, শেষ পর্যন্ত অশান্তির ‘জয়যাত্রা’ কিন্তু ঠেকানো গেল না। পশ্চিমবঙ্গের গায়ে লেগে থাকা কালি তাতে আরও ঘন হল। শনিবার, চতুর্থ দফার ভোটে কোচবিহারের শীতলখুচিতে যা ঘটল, বঙ্গবাসী হিসেবে আমরা সকলেই সেই কালিমার অংশীদার। সেই সঙ্গে এক দুর্ভাগ্যেরও।
ভোটের মধ্যপর্বে এই ঘটনা রাজনীতিকেও অকস্মাৎ এক অন্য মোড় দিল। আসন্ন দিনগুলিতে এটিই হতে পারে সবচেয়ে বড় বিষয়। ভোটের গতি নির্ধারকও বটে। নিহতদের অন্য পরিচয় যা-ই হোক, তাঁরা কেরল থেকে নিজের বাড়িতে ভোট দিতে আসা পরিযায়ী শ্রমিকও বটে। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি যদি ‘ব্যাক ফায়ার’ হয়ে যায়!
শুধু এই রাজ্যে আট দফা ভোট কেন, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন এখানকার আইনশৃঙ্খলার দিকে আঙুল তুলেছিল। কথাটি হয়তো খুব ভুল বলা যাবে না। কারণ লোকসভা, বিধানসভা তো বটেই, পঞ্চায়েত নির্বাচনেও রক্তস্নানের নজির গড়েছে এই রাজ্য। এবং তা শুধু তৃণমূল আমলে নয়। বাম-জমানাতেও ভোটে মৃত্যু-মিছিল দেখতে হয়েছে বারবার।
কিন্তু এ বার যা হল, সেটা সম্ভবত নজিরবিহীন। নির্বাচন কমিশনের ‘নিয়ন্ত্রণে’ থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি করে একের পর এক লোক মেরে ফেলছে—এমন দৃশ্য সত্যিই আগে দেখতে হয়নি!
শীতলখুচিতে আইনশৃঙ্খলার কতটা অবনতি ঘটেছিল, সেই প্রশ্ন অবশ্যই সবচেয়ে জরুরি। তবে বিভিন্ন সূত্রে ঘটনার যে-সব বিবরণ সামনে আসছে, তাতে কতকগুলি বিষয় স্পষ্ট। যেমন, গুলি চালানোর আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং বুথ-রক্ষায় আর কোনও পদক্ষেপ করেনি। সাধারণত গুলির আগে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। জনতাকে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করে হুমকিও দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু হয়েছিল কি? তেমন খবর নেই। তাই সংশয় সেখানেও।
নিরাপত্তাবাহিনীর রাইফেল ছিনিয়ে নিতে যাওয়ার যে অভিযোগ উঠছে, তা ‘যথার্থ’ হলে নিশ্চয়ই তার আগে কোনও সংঘাত হয়ে থাকবে। যে উন্মত্ত জনতাকে সামলাতে রাউন্ডের পর রাউন্ড গুলি চালাতে হয়, তাদের সঙ্গে সংঘাত হলে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় বাহিনীর কেউ গুরুতর ভাবে জখম হবেন, ধরে নেওয়া যায়। তেমন কিছু হয়েছে বলেও জানা নেই। এমনকি, পুলিশের কয়েক জন জখম হয়েছেন বলা হলেও তাঁদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য রাত পর্যন্ত মেলেনি।
এটা ঘটনা যে, বুথের ভিতরে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর হয়েছে। খুবই গর্হিত, নিন্দনীয় এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য সেই অপরাধ। তবে একেবারে বিরল নয়। আর তার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী একেবারে মাথা ও বুক নিশানা করে বিরামহীন গুলি চালাবে, এই কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সহজ পাঠ? বাহিনীকে যেভাবে ‘আড়াল’ করার চেষ্টা চলছে, তা-ও চোখে পড়ার মতো।
কে বলতে পারে, এই ঘটনাকে সামনে রেখে আগামী দিনে হয়তো বা রাজ্যে বিশ দফায় ভোটের পথ ‘খুলে’ যাবে! সে সব না-হয় পরের কথা। আপাতত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে যেসব প্রশ্ন, সন্দেহ, অভিযোগ দানা বাঁধছে, গণতন্ত্রের মহোৎসব তাতেও গরিমা হারায়।
কোচবিহারে রাজনৈতিক নেতাদের যাওয়ার উপরে কমিশন নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেখানে পৌঁছনোর বিষয়টি কোথায় গড়াবে, জানি না। তবে পঞ্চম দফার ভোটের প্রচার ৭২ ঘণ্টা আগে বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনাচক্রে তাতে উত্তরবঙ্গে মমতার কিছু ঘোষিত কর্মসূচি ধাক্কা খেতে পারে। যদিও বিজেপির বড় কর্মসূচি ওই সময়সীমার আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।