নিশ্চিন্তি: বাড়ির উঠোনে চলছে নকশি কাঁথা বোনা। গড়বেতার চমকাইতলায়। নিজস্ব চিত্র।
ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ
মাঠের পাশ দিয়ে লাল মোরামের রাস্তাটা চলে গিয়েছে। রাস্তার অন্য পাশে ছোটখাটো বসতবাড়ি। কাঁচা, পাকা। তারই একটির উঠোনে চাটাই পেতে নকশি কাঁথা বুনছিলেন
আসিরা বিবি।
‘‘নিজেদের জন্য বানাচ্ছি। শেষ হতে তিন-চার দিন লাগবে।’’ কথা শুনে আশপাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন কয়েক জন। এক উঠোনে বসবাস। পড়শি হীরা খানের বয়স আসিরার থেকে একটু কম। হেসে বলেন, ‘‘আমি কিন্তু আরও ভাল নকশা করতে পারি।’’
ফাঁকা মাঠে মাঝ ফাল্গুনের নিঝুম দুপুর নেমেছে। বড় শান্ত আশপাশ। সেই শান্তির ছাপ সবার হাবেভাবেও। এই মাঠেই বছর কুড়ি আগের এক দুপুরের কথা মনে আছে প্রৌঢ় সহিদুল শেখের। ২০০০ সালের ৯ অগস্ট। ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েছিল সে দিন। এই মাঠে সভা করে অখ্যাত চমকাইতলাকে বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রে পরিচিত করে দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী, তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই অতীত ভোলেননি কেউ। তখন এলাকায় শান্তি ছিল না। এলাকা দখলের লড়াই থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াতে হত। এখন শান্তি ফিরেছে। অনেকে পাট্টা পেয়েছেন, অনেকে পাননি। পাকা বাড়িও হয়েছে অনেকের। তরুণ সোহরাব আলি মল্লিক বলেন, ‘‘কিছু বাড়িতে বিদ্যুৎ আসেনি। ছোটদের পড়াশোনার অসুবিধে হয়...’’ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে আসিরা বিবি বলেন, ‘‘মাথার উপর ছাদ আছে, এক জায়গায় শান্তিতে থাকতে পারছি, এটাই অনেক মনে হয়। যা দিন দেখেছি আমরা!’’
একুশ বছর আগের মমতার সভা অবশ্য দেখতে পাননি সাইদুল মল্লিক। ‘‘আমি তো তখন ঘরছাড়া। বনে-জঙ্গলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম।’’ ১৯৯৮ সালে খুন হন তাঁর বাবা, তৃণমূলকর্মী আসর মল্লিক। অভিযোগ, সিপিএমের দুষ্কৃতীরাই এই কাজ করেছিল। এখন মাঠের পাশেই পরিবার নিয়ে থাকেন সাইদুল। বলছিলেন, ‘‘নিজের জমি নেই। খেটে খাই।’’ স্কুলের পোশাকে স্কুল থেকে ফিরছিল এক বালিকা। সাইদুল চিনিয়ে দেন, ‘‘আমার ভাইঝি।’’ ওই বয়সেই প্রাণ বাঁচাতে পালাতে হয়েছিল সাইদুলকে। তাঁর মনে পড়ে, ‘‘কয়েক বছর পরে ফিরে আসতে পেরেছিলাম। পরিশ্রম করে বাড়ি করেছি।’’ সরকারি জমি। যদি উঠতে বলে তবে উঠে যেতে হবে। এমনিতে শান্তিতেই আছি।’’
মোরাম রাস্তাটা কিছু দূর গিয়ে শেষ। বাকিটা বাঁধানো। ফলক দেখে জানা যায়, পঞ্চায়েতের কাজ। সেই বাঁধানো রাস্তা দিয়েই হেঁটে আসছিলেন প্রসেনজিৎ সরেন। গন্তব্য আলু খেত। কাঁধে কোদাল, হাতে মোবাইল। পরনে ফুটবল ক্লাব চেলসির জার্সি। টিভিতে ফুটবল দেখেন প্রসেনজিৎ। প্রিয় ফুটবলার নেইমার। এ বারেই প্রথম ভোটার তালিকায় নাম উঠেছে। জানালেন, ক্লাস এইটের পরে আর পড়াশোনা করেননি। চাষের কাজই করেন দাদার সঙ্গে।
চাষ এই এলাকায় ভাল হয়। ‘‘এ বার অবশ্য আলুর দাম নেই, কোনও রকমে চাষের খরচ উঠলে হয়’’, পাশের জমি থেকে বললেন সমীর দিগার। রাস্তা শেষ হয়েছে আদিবাসী পাড়ায়। সব বাড়ির সামনেই কাঠকুটো জড়ো করা। দাওয়ায় বসে থাকা ফাল্গু টুডু বলেন, ‘‘গ্যাস অনেকে নিয়েছিল, শেষ হয়ে যেতে আর কেনেনি। যা দাম! আমি নিইনি।’’
প্রাণে বাঁচতে এই পাড়ার দিকেই পালিয়ে আসছিলেন সুফিয়া বিবি। তখন এলাকা অশান্ত। সব মনে আছে তাঁর। বললেন, ‘‘গয়নাগাঁটি যা ছিল তা নিয়েই ঘর ছেড়ে পালাচ্ছিলাম। পৌঁছনোর আগেই বন্দুক দেখিয়ে সব কেড়ে নিয়েছিল গুন্ডারা।’’ এখন মাটির ঘরেই থাকেন। ‘‘রেশন পাই, স্বামী ছাতা সারানোর কাজ করেন। ঘরটা পাকা হলে ভাল হত। তবে অশান্তি আর নেই।’’
অনেক কিছু নেই এখনও। তবে শান্তি আছে। বাঁকুড়া, হুগলি লাগোয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের এই এলাকায় ঘুরলে তা বোঝা যায়। চমকাইতলা মাঠের পাশেই চমৎকারিণী দেবীর মন্দির। সামনে সৌন্দর্যায়নের কাজ হচ্ছে। শালের ছায়াঘেরা চত্বরে বসলে শোনা যায় পাশেই স্কুলে ইংরিজি পড়াচ্ছেন শিক্ষিকা। গড়বেতার পথে উত্তরবিলে আরেকটি স্কুল রয়েছে। সামনে ফুচকা খাচ্ছিল পড়ুয়ারা। উঁচু ক্লাসের জন্য ক’দিন আগে খুলেছে স্কুল। আগে বাড়ির একটা মোবাইলে পড়ার অসুবিধে হত, সরকারি প্রকল্পের ট্যাব পাওয়ায় সুবিধে হবে— জানায় একজন।
চমকাইতলা থেকে গড়বেতার দূরত্ব কিলোমিটার পঁচিশ হবে। পাকা রাস্তার ধারে নলকূপের জলে আনাজ চাষ হয়। কাজুবাদামের বনও দেখা যায় লালমাটিতে। এই বন জঙ্গল,
লাল মোরামে মিশেছে অনেক রক্ত। নানা সময়ে। তা বহন করে বাঁশদায় ১৯৪৯ সালের কৃষক আন্দোলনে নিহত তিন জনের শহিদ স্মারক, সন্ধিপুরে শ্রীপতি শিক্ষা সদনের ভিতরে থাকা ১৯৯৯-এ চার জনের খুনের স্মরণে থাকা শহিদ বেদি। শহিদ বেদির সেই লেখা এখন আবছা।
ছোট আঙারিয়া গ্রামের শহিদ বেদির চত্বরে খেলছিল খুদেরা। সামনে তৃণমূলের পতাকা উড়ছে। চমকাইতলা-গড়বেতা রাস্তা থেকে পাকা রাস্তা ধরেই আসা যায়। আগে পাকা ছিল না রাস্তা। ২০০১-এ হত্যাকাণ্ডের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাটির রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটেই এসেছিলেন গ্রামে। সঙ্গী ছিলেন এনডিএ শরিক জর্জ ফার্নান্ডেজ। সেই ঘটনাস্থল চিনিয়ে দেন বাড়ির মালিক বক্তার মণ্ডল। লাগোয়া জায়গায় অন্য বাড়ি করেছেন বক্তার। সুগারের রোগী বক্তারের চায়ের কাপ চিনিয়ে দেন স্ত্রী আয়েষা।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বক্তার বলেন, ‘‘জমিজমা যে টুকু আছে, চাষ করে চলে যায়। এখন কোনও ঝামেলা নেই। এলাকায় সবাই শান্তিতেই আছে।’’