প্রতীকী ছবি।
সিজুয়া ঘাট থেকে ডাইনাটিকরি, কাঞ্চনডাঙ্গা, কাঁটাপাহাড়ি হয়ে চওড়া রাস্তা মিশেছে লালগড়ে। নতুন হলেও পিচের চিহ্নটুকু নেই সে-পথে। বড় বড় গর্তে গাড়ি চলেছে দুলকি চালে। উল্টো দিক থেকে কানফাটা জান্তব আওয়াজ করতে করতে একের পর এক চলেছে আটটা-দশটা বড়-ডালার শক্তিশালী ট্রাকের কনভয়। গন্তব্য সিজুয়ার ঘাট। শীর্ণস্রোতা কংসাবতীর বুক ছেঁচে তোলা রাশি রাশি বালি পেটে ভরে মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, খড়গপুর হয়ে দেশের নানা পাটে ছড়িয়ে পড়বে এই সব ট্রাকের দঙ্গল। অঝোরে পড়ে জল। তার সঙ্গে হাজারো ট্রাকের বিশালকায় টায়ার দরকারি রাস্তার দামি পিচটুকু সাপটে চেঁছে নিয়েছে। ট্রাকের পিছনে ওড়া রাঙা-ধুলোর কুণ্ডলী থেকে রক্ষা পেতে গামছায় নাক-মুখ মুড়ে সাইকেল থেকে সাবধানে নেমে দাঁড়িয়েছেন কাজ-ফেরত স্থানীয়রা। কঠিন দৃষ্টি। পারলে যেন ভস্ম করে দেন ট্রাকের সারিকে।
এই যে বালি তোলা হচ্ছে, সবটাই তো আইন ভেঙে?
জবাবে ঘাড় নাড়েন ছত্রধর মাহাতো, “সবটাই আইন ভেঙে।” এ ভাবে দিন-রাত এমন বেআইনি কাজ মানুষের চোখের সামনে যে হয়ে চলেছে, ঠেকানোর কেউ নেই?
এক সময়ে পুলিশি অত্যাচার-বিরোধী জনসাধারণের কমিটির নেতা, মাওবাদী সংস্রব ও নাশকতার মামলায় জেলে খেটে এসে শাসক দলের রাজ্য নেতা হয়ে ওঠা ছত্রধর দৃশ্যত অস্বস্তিতে। অসহায় স্বরে বলেন, “কী বলব বলুন! শুনেছিলাম রাতে ট্রাক চলাটা বন্ধ করছে পুলিশ। কোথায় কী!”
যত্রতত্র সাকশান যন্ত্রে বালি তোলায় বিপন্ন কংসাবতীর পাড়ের বহু গ্রাম। বর্ষা নামলে পাহাড়ের ওপর থেকে নামে হড়পা বান। শীর্ণ নদী আচম্বিতে হয়ে ওঠে উপুচুপু। ফোঁপরা পাড়ের কানাচে জল সেঁধিয়ে নামে ধস। নিমেষে তছনছ ঘর-উঠোন, গেরস্থালি। শুকনো দিনে স্নানে নেমে বালি তোলা গর্তে থই না-পেয়ে ছেলে-ছোকরারা তলিয়েও গিয়েছে।
রাগ জমছে মানুষের। বলছেন তাঁরা— ‘সে দিনকার নেতা’ ছত্রধর আর কী মাতব্বর! কে না-জানে, শাসক দলের আরও বড় মাথা রয়েছে বালি চক্রে। আর ছত্রধর বলেন, “ঝাড়গ্রাম-লালগড়ে বহু মানুষ আবার চায়ও বালি তোলা চলুক। এরা প্রভাবশালী। বড় বড় আবাসন উঠছে, মার্কেট কমপ্লেক্স হচ্ছে বালির টাকায়। বালির কল্যাণে ফুলে ফেঁপে উঠেছে এলাকা। বন্ধ করা শক্ত।”
প্রচারে, পতাকায়, মাইকে জনসভার উচ্চকিত ঘোষণায় ভোটের উত্তাপ। ঝাড়গ্রামে সাত সকালে চা-চক্র দিয়ে শুরু করে গোটা দিন টইটই প্রচার সেরে সাঁঝ-সন্ধ্যায় দোকানে হাজির জোড়াফুলের প্রার্থী বিরবাহা হাঁসদা। টুথপেস্ট, চায়ের প্যাকেট আর টুকিটাকি জিনিস কিনে রাস্তা পেরনোর সময়ে পাড়াতুতো কাকার মুখ-ঝামটা, “একা একা ঘুরছিস? ঘর যা শিগ্গির!” হেসে ওঠেন সাঁওতালি চলচ্চিত্রের পরিচিত নায়িকা, “এই তো!” সকাল থেকে ধামসা বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন গোপীবল্লভপুরের জোড়া ফুলের প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ মাহাতোও।
হিমাচলি টুপি পরে সঙ্গীসাথী নিয়ে ঝাড়গ্রামের পরিচিত চায়ের দোকানের আড্ডায় পদ্মের সুখময় শতপথী, ‘গোপীবল্লভপুরের গর্ব’ দিলীপ ঘোষের পাশে থেকে আরএসএস করা। দোকানে দোকানে তাঁর ইস্তাহার বিলি হচ্ছে, যাতে লেখা— ‘শিক্ষাগত যোগ্যতায় যুবক-যুবতীদের চাকরি নেই, খুনি তকমা থাকলেই চাকরি। যারা খুনি, মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্যাকেজ তাদের জন্য কেন? যাঁরা খুন হলেন, তাদের অসহায় পরিবারের জন্য কিছু নেই কেন?’ পায়ে চাকা লাগিয়ে প্রচারে নেমেছেন গোপীবল্লভপুরে সুখময়ের দলের প্রার্থী সঞ্জিত মাহাতোও।
কলকাতায় ছাত্র রাজনীতির পরিচিত মুখ মধুজা সেনরায় আগের দিন ঝাড়গ্রামে প্রচার সেরে সাতসকালেই ছুটছেন বিনপুরে। পাশের কেন্দ্র গোপীবল্লভপুরে তাঁর দলের প্রার্থী এক সময়ের ‘দাপুটে নেতা’ প্রশান্ত দাস। বামেদের দাবি, তিনি প্রার্থী হওয়ায় উৎসাহে ফুটছেন কর্মীরা। প্রতিপক্ষ বলছেন, ‘দাঁত ভাঙা হার্মাদ নেতা।’ কাস্তে-হাতুড়ি-তারা প্রতীক আর লাল পতাকায় মোড়া কয়েকটা গাড়ি সমানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ‘লাল ফেরাও, হাল ফেরাও’ আওয়াজ তুলে।
কিন্তু যাঁদের জন্য সব কিছু, সেই ভোটারেরা যেন বড় বেশি চোয়াল-কষা। এই আমলে ঝাড়গ্রামের পরিকাঠামোর উন্নতি তাক লাগিয়ে দেয়। কংসাবতীর উপরে নতুন সেতু ‘প্রত্যন্ত’ তকমা হটিয়ে লালগড়কে এনে দিয়েছে ঝাড়গ্রামের কোলের পাশে। কাল যারা বন্দুক নিয়ে ঘুরেছে, প্যাকেজ নিয়ে আজ তারা শাসক দলের মেজ-সেজ-ছোট নেতার দল। পিছিয়ে পড়া অধিকাংশ মানুষই কিছু-না-কিছু সরকারি সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু এই পাওনাগণ্ডাই যেন অবিশ্বাস বুনে দিচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে, শাসক দলের বিরুদ্ধে। একটা দলের বিরুদ্ধে নালিশ— তারা অনেক পাচ্ছে, আমরা কম। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেতে গেলে ওদের হাতে দু-পাঁচশো দিতেই হবে। কেন দেব? ভোটের মুখে বিরোধীরা হাওয়া দিচ্ছে সেই আঁচে। এই ক্ষোভই কি জমতে জমতে হড়পা বান হয়ে নেমে আসবে ২৭ তারিখ ভোটের দিনে? বিজেপির সদ্যপ্রাক্তন জেলা সভাপতি সুখময়ের দাবি, “আসবেই, আপনি লিখে নিন! কাটমানির সরকারকে হটাতে মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।”
ঝাড়গ্রামের জামদো সার্কাস মাঠে অমিত শাহের চেয়ার-ফাঁকা জনসভা অবশ্য প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, সুখময়ের দাবি কি তবে নেহাতই ‘চুনাবি জুমলা’? পাশাপাশি লালগড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় মাঠ-ওপচানো ভিড়। নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের আঘাত নিয়ে গোপীবল্লভপুরের সরডিহা থেকে লালগড়ের ছোটপেলিয়া পর্যন্ত যে আন্তরিক উদ্বেগ, বোঝা যায় ঝাড়গ্রাম, দহিজুড়ি, নেতাই, কাটাপাহাড়িয়া বা লালগড়ে তাঁর ভাবমূর্তিকে হিসেবে না-রাখাটা মস্ত ভুল হবে। জনবিক্ষোভের হড়পা বানে সেটাই রিংবাঁধ হয়ে উঠতে পারে শাসক দলের কাছে।
লোকসভার ভোটে দুই কেন্দ্রেই পদ্মফুল সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। বিধানসভা ভোটের খেলাটা কিন্তু অন্য পিচে।