ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নিয়ে আসা হল ছত্রধরকে। রবিবার। ছবি:বিশ্বনাথ বণিক
সিপিএম নেতা খুন ও রাজধানী এক্সপ্রেস পনবন্দি মামলায় শাসক দলের জঙ্গলমহলের নেতা ছত্রধর মাহাতোকে গ্রেফতার করল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। রবিবার ভোরে লালগড়ের বাড়ি থেকে ছত্রধরকে গ্রেফতার করা হয়। এ দিন কলকাতার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ছত্রধরকে পেশ করা হলে বিচারক ৩০ মার্চ পর্যন্ত তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর ঝাড়গ্রামের বাঁশতলায় ভুবনেশ্বর থেকে নয়াদিল্লিগামী রাজধানী আটক করেছিল মাওবাদী ও জনসাধারণের কমিটির লোকজন। ওই মামলায় ছত্রধরকে অভিযুক্ত করে এনআইএ। রাজধানী-আটকের সময়ে ছত্রধর জেলবন্দি ছিলেন। তাঁর মুক্তির দাবিতেই বাঁশতলায় রাজধানী এক্সপ্রেস থামিয়েছিল সশস্ত্র মাওবাদীরা। এনআইএ-র দাবি, জেলে বসে ছত্রধরই রাজধানী আটকের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সেই কারণেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ছত্রধরের আইনজীবী মিঠু দাস এ দিন বলেন, ‘‘২০২০ সালের নিম্ন আদালতের একটি গ্রেফতারি পরোয়ানার ভিত্তিতে ছত্রধরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার মক্কেলকে আটক করার পর মারধর করা হয়েছে বলে বিচারকের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে।’’ বিষয়টি এনআইএ-র তরফে অস্বীকার করা হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন ছত্রধরকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এনআইএ-কে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
ছত্রধরের গ্রেফতারির পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই বলে রবিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন। এই গ্রেফতারি নিয়ে আজ আনন্দবাজারের প্রশ্নের উত্তরে অমিত শাহ বলেন, ‘‘গতকাল ওঁর এলাকায় ভোট হয়ে গিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ছত্রধর মাহাতো মুক্ত ছিলেন।’’
২০০৯ সালে সিপিএম নেতা প্রবীর মাহাতো খুন ও রাজধানী এক্সপ্রেসকে পনবন্দির মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশে ছত্রধর সপ্তাহে তিন দিন তদন্তকারী সংস্থার অফিসারদের মুখোমুখি হচ্ছিলেন। গত শুক্রবারেও তিনি সল্টলেকের এনআইএ সদর দফতরে হাজির হয়েছিলেন। রাতে লালগড়ে ফিরে গিয়েছিলেন। শনিবার জঙ্গলমহলে তৃণমূলের হয়ে ভোট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ছত্রধর।
শনিবার সকালে লালগড়ের বীরকাঁড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোট দেওয়ার পরে আর ভোটের ময়দানে দেখা যায়নি জঙ্গলমহলে ‘তৃণমূলের মুখ’ ছত্রধরকে। তাঁর মা বেদনবালা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশালিটিতে ভর্তি করানো হয়। রাতে নিজের দায়িত্বে মাকে রিলিজ করিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান ছত্রধর।
রাতে আমলিয়া গ্রামের মাটির বাড়ির দোতলার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ৭০০ মিটার দূরে হরিহরপুরের পিচ রাস্তার ধারে সদ্য তৈরি হওয়া পাকা বাড়িতে ছত্রধরের গাড়ির চালক, তাঁর দুই নিরাপত্তা রক্ষী ও বড় ছেলে ধৃতিপ্রসাদ ঘুমোচ্ছিলেন। রাত তিনটে নাগাদ এনআইএ-র তদন্তকারী অফিসার কাঞ্চন মিত্রের নেতৃত্বে আসা প্রায় ৪০ জনের দল ধৃতিপ্রসাদকে ডেকে তোলে। সঙ্গে মহিলা কেন্দ্রীয় পুলিশও ছিল। সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ধৃতিপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে ছত্রধরের পুরনো মাটির বাড়িতে হানা দেয় এনআইএ-র দলটি।
ছত্রধরের স্ত্রী নিয়তির অভিযোগ, দরজা ভেঙে এনআইএ পরিচয় দিয়ে ওই দলের লোকজন ঘুমন্ত ছত্রধরকে দোতলা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনেন। ছত্রধর তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। এনআই অফিসারদের সঙ্গে তাঁর ধস্তাধস্তিও হয়। নিয়তির অভিযোগ, গামছা ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই ছত্রধরকে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তোলা হয়। পোশাক পরতেও দেওয়া হয়নি। চশমাও সঙ্গে নেওয়ার সুযোগ পাননি ছত্রধর। মাটির বাড়িতে ছত্রধরের আরও তিন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। তাঁদেরও ফোন ও বন্দুক কেড়ে নেওয়া হয়।
ছত্রধরের স্থানীয় আইনজীবী কৌশিক সিংহের দাবি, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে ছত্রধর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় অভিসন্ধি নিয়ে প্রথমে সিপিএম কর্মী খুনের পুরনো মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। রাজধানী আটকের সময়ে ছত্রধর জেলবন্দি ছিলেন। তা সত্ত্বেও ওই মামলায় ইউএপিএ ধারা যুক্ত করে পরিকল্পিতভাবে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।’’ এনআইএ সূত্রের পাল্টা দাবি, ছত্রধরের ‘অ্যারেস্ট মেমো’তে সই করতে চাননি নিয়তি। উল্টে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাজে বাধা দেওয়া হয়। তাঁদের সঙ্গে থাকা এক জন কনস্টেবল জখমও হয়েছেন।
প্রথম দফার ভোট মিটে যাওয়ার পরে রবিবার পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি বিধানসভা আসনে ভোট পরিচালনার জন্য দলের তরফে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। তার মধ্যে ছিল নন্দীগ্রামও।