নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী দাঁড়ানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের বিধানসভা নির্বাচনে একের পর এক ‘রাজনৈতিক নির্দল’রা সর্বত্র যে ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছেন, তা যথেষ্ট চিন্তায় ফেলেছে সব ক’টি বড় রাজনৈতিক দলকেই।
কংগ্রেস, তৃণমূল এমনকি বাম প্রার্থীদেরও এবারে নিজের দলেরই নির্দলদের কোপে পড়তে হচ্ছে যেভাবে তাতে আশঙ্কা “বাড়া ভাতে ছাই পড়তে পারে” অনেকেরই।
এমনিতেই শমসেরগঞ্জ, রানিনগর ও মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে জোট ভেঙে বাম ও কংগ্রেসের যৌথ উপস্থিতির সম্ভাবনা দুটি দলকেই এতটাই বিপাকে ফেলেছে এবারে, যার জেরে কোনও কোনও আসনে অনেকটাই সুবিধা পেয়ে যেতে পারে বিজেপি ও তৃণমূল।
জলঙ্গি, সুতি, রঘুনাথগঞ্জ, সাগরদিঘি, নওদার মত আসনে রাজনৈতিক নির্দলদের দাপট যেভাবে বেড়েছে তাতে কার ভোট কে কাটবে সেই হিসেবের অঙ্ক গুলিয়ে দিতে পারে অনেকটাই।
সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে কংগ্রেস নওদায়। সেখানে সরাসরি কংগ্রেস মোশারফ হোসেনকে প্রার্থী করার প্রতিবাদে কংগ্রেস ছেড়েছেন ব্লক কংগ্রেসের একাধিক নেতা। জোট ভেঙে নির্দল প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য শমীক মণ্ডল। তিনি আবার দলের এরিয়া কমিটির সম্পাদকও। তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন জেলা কমিটির আর এক সদস্য গোরাচাঁদ ঘোষ। মূলত দল চালাতেন তাঁরাই। ফলে সিপিএমের বেশির ভাগ নেতাই শমীকের পক্ষে। যদিও ইতিমধ্যেই সিপিএম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে শমীক সহ আরও এক নেতাকে। কিন্তু তাতেও থামানো যায়নি সিপিএমের নওদার বিক্ষুব্ধদের। লাল ঝান্ডা নিয়েই প্রচারেও বের হচ্ছেন তাঁরা।
শমীকের সাফ কথা, “লাল ঝান্ডা ও কাস্তে হাতুড়ি মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক। তা ছাড়া আমিও তো মনেপ্রাণে সিপিএমই। তাই লালঝাণ্ডার কথা বলেই লড়ছি।”
জলঙ্গিতে প্রার্থী নিয়ে বিক্ষোভ আবার তৃণমূলে। সিপিএম বিধায়ক আব্দুর রাজ্জাক তৃণমূলে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন সেখানে। পাল্টা সেখানে নির্দল প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূলেরই জেলা পরিষদ সদস্য রাফিকা সুলতানা। প্রচারেও নেমে পড়েছেন পুরোদমে। তার কথা, “রাজ্জাক কতটা অযোগ্য প্রার্থী মানুষের রায় থেকেই তা জানতে পারবে দল।”
সুতিতে দলীয় প্রার্থী ইমানি বিশ্বাসকে পছন্দ হয়নি বহু তৃণমূল নেতার। প্রতিবাদে দল ছেড়েছেন তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্য মইদুল ইসলাম। দাঁড়িয়ে পড়েছেন নির্দল হয়ে। তার দেওয়াল লিখনে ভরে উঠেছে সুতির গ্রাম-গঞ্জ।
সেখানে একই অবস্থা কংগ্রেসেও। হুমায়ুন রেজাকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। মানতে অস্বীকার করে সুতি ২ ব্লক সভাপতি সহ প্রায় গোটা ব্লক কংগ্রেসের নেতারাই দল ছেড়েছেন সেখানে। তারা সকলেই সমর্থনের হাত বাড়িয়েছেন জেলা পরিষদের সদস্য নির্দল মইদুল ইসলামের দিকে। ব্লক কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী করে প্রচারে নেমে পড়েছেন ইতিমধ্যেই। তার জেরে কংগ্রেসের প্রচার ও দেওয়াল লিখন দূরবীন দিয়েও নজরে পড়ে না।
কংগ্রেস প্রার্থী বহিরাগত, তাই মানতে রাজি নয় কংগ্রেসের বহু নেতা সাগরদিঘিতেও। সেখানে সব দলের প্রার্থীই বহিরাগত। তাই এক ভূমিপুত্রকে দাঁড় করিয়ে লড়ছেন তারাও। রঘুনাথগঞ্জ কেন্দ্রে প্রার্থী দুর্বল, হারাতে পারবে না তৃণমুলকে। প্রতিবাদে সেখানেও তৃণমূলের এক পদত্যাগী জেলা পরিষদ সদস্য নাসির শেখকে প্রার্থী করে দিয়েছেন তারা। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে মনোনয়ন দাখিল। তারপরেই স্পষ্ট হবে জেলার ২২টি আসনে এই ধরণের রাজনৈতিক নির্দলের সংখ্যা কত। এবং তাতে কোথায় কার ক্ষতি?
কিন্তু কেন এত রাজনৈতিক নির্দলের সংখ্যা বাড়ছে?
ফরাক্কার কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হক ২৫ বছর ধরে বিধায়ক হয়ে রয়েছেন ফরাক্কায়। তিনি এআইসিসি’র সম্পাদকও। বলছেন, “আগে এসব ছিল না। প্রার্থী ঘোষণার আগে ব্লকের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হত। তারাই নাম ঠিক করে পাঠাতেন। জেলা, রাজ্য হয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দিত সেই নাম। এখন সব দলেই এটা হয় না। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রার্থী। আর তাতেই এত ক্ষোভ।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জ্যোতিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “সিপিএমের মধ্যে নিচু তলা থেকে আলোচনা করেই প্রার্থী বাছাই হয়। তাই বিক্ষোভ নেই। নওদায় শমীক মণ্ডল গত নির্বাচনেও দলের নির্দেশ না মেনে কাজ করেছিলেন। তাই দল বহিষ্কারে বাধ্য হয়েছে এবারে।’’