ফাইল চিত্র।
প্রথমবারের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল আর্থিক। দ্বিতীয়বারের শেষ বছর বড় চ্যালেঞ্জ ছোড়ে কোভিড। তৃতীয়বারের শুরু থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সামনে আরও আগ্রাসী কোভিডকে মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ এসেছে। সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আর্থিক পরিস্থিতিও সঙ্কট তৈরি করতে পারে। বলা যেতে পারে, ঘুরেফিরে সেই আর্থিক অবস্থাই ফের চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে।
তৃতীয়বারের জন্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত দু’দফার সরকারে সামাজিক এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিপুল বরাদ্দ এবং কাজ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এ বারের প্রবল জনসমর্থণে সরকারের উপর মানুষের আরও প্রত্যাশা বাড়ল বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। গত দু’দফায় আর্থিক কাঁটা বিঁধেছে প্রশাসনিক কর্তাদের। গত বছর কোভিড মোকাবিলায় বিপুল খরচ করতে হয়েছে রাজ্যকে। রাজ্যের অভিযোগ, বার বার বলা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অর্থ দেয়নি কেন্দ্র। ফলে কোষাগারের উপর চাপ অনেক বেড়েছে। তা ছাড়াও ছিল আমপানের বিপুল খরচ। সেই খাতে টাকা পাওয়া নিয়েও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে রাজ্যের। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি ছিল, রাজ্যকে ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন তাঁরা। যদিও রাজ্যের বক্তব্য, আমপান খাতে হাজার চারেক কোটি টাকা মিলেছে।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, এই মুহূর্তে বকেয়া অর্থ রাজ্যের হাতে আসা খুবই জরুরি। কারণ, একদিকে যেমন নতুন সরকারকে সামাজিক এবং পরিকাঠামো খাতে খরচ করতে হবে, তেমনই জনস্বাস্থ্যের প্রবল চাপও সামলাতে হবে সমান্তরাল ভাবে।
গত বছরের প্রায় শেষ পর্যন্ত রাজ্যের দাবি ছিল, সম্মিলিত ভাবে বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের পাওনা রয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এ বছরের প্রায় শুরু থেকেই ভোট-প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় ফলে খরচের মিটার থেমে থাকেনি। এর উপর আট দফার ভোটে (চূড়ান্ত হিসেব এখনও বাকি) খরচের বহর ১৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তারা। ঘটনাচক্রে ভোটপর্বের মধ্যেই কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ে। ফলে তা মোকাবিলাতে তড়িঘড়ি পদক্ষেপ করতে হয় সরকারকে। এক কর্তার বক্তব্য, “কেন্দ্রের কাছে এখন সর্বমোট কত টাকা বকেয়া রয়েছে, তার হিসেব কষার কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত কত টাকা এসেছে, কোন খাতে কত টাকা এখনও পাওয়া
যায়নি, ইত্যাদি সব তথ্যই সেই হিসেবের অঙ্গ। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত তথ্য তৈরি হয়ে যাবে নতুন সরকারের জন্য।”
সরকারি হিসেবে (২০২০-২১ রাজ্য বাজেটের তথ্য অনুযায়ী) চলতি আর্থিক বছরে (২০২১-২২) রাজস্ব ঘাটতি থাকতে পারে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এর উপরে ঋণ পরিশোধ বাবদ খরচ হতে পারে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এর উপরে রয়েছে বেতন, পেনশন, সামাজিক খাতের বরাদ্দ- সহ একাধিক প্রয়োজন। এই অবস্থায় বকেয়া অর্থ হাতে এলে পরিস্থিতি সামলাতে রাজ্যের কিছুটা সুবিধা হতে পারে বলে মনে করছেন আর্থিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।
সোমবারই মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন সরকারের প্রাথমিক কাজই হবে কোভিড ঠেকানো। চলতি পরিস্থিতিতে তাই এ কাজে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করবে সরকার। বস্তুত, গত বছরের যে সংক্রমণের হার এ রাজ্যে ছিল, এ বছর সেই রেকর্ড প্রায় শুরুতেই ভেঙে গিয়েছে। এখন সংক্রমণের চরিত্র গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী। সেই কারণে ভোট চলাকালীনই এ ব্যাপারে সরকারি পদক্ষেপ শুরু হয়ে গিয়েছে। গত বছরের সর্বোচ্চ সংক্রমণের তুলনায় অনেক গুণ ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হচ্ছে এ বছর। চিকিৎসা খরচও সমান্তরাল হারে বেড়েছে। সরকারি, সরকারি অধিগৃহীত বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো ছাড়াও চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সব জায়গায় নিখরচায় রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে সরকার। বেসরকারি হাসপাতালেও বাড়ানো হচ্ছে শয্যা সংখ্যা। এর পাশাপাশি, ঘাটতি মেটাতে কয়েক কোটি প্রতিষেধক কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। সেই খাতেও বিপুল খরচ অপেক্ষা করছে।
ভোটের আগেই রাজ্যে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের বহর বাড়ানো হয়েছিল। নিখরচায় রেশন পরিষেবা চালিয়ে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। পাশাপাশি, কন্যাশ্রী, কৃষকবন্ধুর মতো প্রকল্পও রয়েছে। কৃষকবন্ধু প্রকল্পে উপভোক্তাদের বাৎসরিক আর্থিক সুবিধা ছয় থেকে বাড়িতে দশ হাজার টাকা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শাসকদল। ফলে সেই বাবদ বাড়তি অর্থ ধরে রাখতে হবে। সব মিলিয়ে আর্থিক চ্যালেঞ্জকেই মুখ্য হিসেবে দেখছেন প্রশাসনিক কর্তারা।