সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে এই ছবি।
মানুষের কত কাছে তিনি পৌঁছতে পারেন, স্পষ্ট ভাইরাল ছবিতেই। শুধু খড়্গপুর নয় তা দেখে ফেলেছে গোটা রাজ্য।
সাবানে সাবানে ফেনায়িত স্নানরত অবয়বের পাশে গেরুয়া জ্যাকেট, উত্তরীয়ধারী সহাস্য প্রার্থী। যিনি বলছেন, "আমি কিন্তু বাথরুমে ঢুকিনি! ওই বস্তিতে মেয়েপুরুষ সবাইকেই রাস্তায় স্নান করতে হয়। আমি চাই ছবিটা দেখুক সকলে।"
পোশাকি নাম হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়। রুপোলি পর্দায়, হিরণ। আর টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ার চালু লব্জে, ‘হিরো হিরণ’। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তৃণমূল লবির খোঁচা, বিজেপি-র যশস্বী জাতীয় নেতাদের সামনেও তিনি না কি ‘হিরো হিরণ বলছি’ বলেই কথা শুরু করেন।
ভোটযুদ্ধে সেই হিরণই বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মর্যাদা রক্ষার সেনানী। গম্ভীর মুখে বলছেন, ‘‘আমি পলিটিক্সের ছেলে। এটা দিলীপদার জেতা জায়গা। নন্দীগ্রামের পরে সব থেকে প্রেস্টিজ ফাইট।’’ রাজনীতির মিটিংয়ে ফিল্মি ডায়ালগের ধার ধারেন না সপাটে শুনিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
তা বললে কী হবে? রোডশোয়ের প্রচারে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাঙালি-পাড়ায় মাইকে গমগম করছে ‘সুপার-ডুপার হিট দুষ্টু মিষ্টি নায়কে’র কথা। ইন্দা মোড়ে অটোর গায়ে ছবিটায় ১৩-১৪ বছর আগের আনকোরা হিরণ। কোয়েল বা শ্রাবন্তীর হিরো হয়ে যখন জুটি বাঁধছেন। সরু গলিতে হিরণকে দেখে বিকেলের নাচের ক্লাস বন্ধ করে দিদিমণি ও ছাত্রীদের নিজস্বী-হিড়িক। হিরণের কোন ছবি প্রিয়, আলাদা ভাবে মনে না-পড়লেও তাঁদের কাছে প্রার্থী হিরো তো বটেই।
“খড়্গপুরের মানুষ আমায় বলছে, দেবও কখনও এ ভাবে মাটিতে নেমে হাঁটেননি,” দুপুরে বিজেপি-র বিধানসভা কার্যালয় প্রেম হরি ভবনের ঘরে একান্তে বলছিলেন হিরণ। দীর্ঘ কর্মিসভা সবে শেষ। মুরগির ঝোল, ভাত খাওয়া চলছে। হিরণ ভিতরের ঘরে সঙ্গে আনা হোটেলের ঘরোয়া খাবার খেতে ঢুকলেন। “সকাল থেকে তিন ঘণ্টা হেঁটেছি! বিকেল থেকে রাত ফের হাঁটা। আজ আর চান হল না!”— খেতে বসার আগে গেরুয়া জ্যাকেট, পেটে বাঁধা বেল্ট খুলতে খুলতে বলছিলেন হিরণ। জানা গেল, গত বছর জিম করতে গিয়ে চোট পেয়ে পিঠে অপারেশন হয়েছিল! ডাক্তার বকাবকি করছেন। কিন্তু প্রার্থী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, “হাঁটতে আমায় হবেই!”
তাঁর পার্শ্বচর তথা 'ম্যান ফ্রাইডে' শুভাশিস সরকার টিফিন কেরিয়র খুলে ভাত বেড়ে দেন। সঙ্গে লাউয়ের শুক্তো, দই মাছ আর স্যালাড! স্বল্পাহারী। পোস্টারের মুখের সঙ্গে ফারাক থাকলেও ছিপছিপে শরীরে দশ বছর বয়স তিনি লুকিয়ে রেখেছেন।
খড়্গপুরের রোড-শোয়ের থেকেও ঢের আকর্ষক হিরণের তিন দশকের পথচলা। উলুবেড়িয়ার স্কুলশিক্ষকের কনিষ্ঠ তথা অষ্টম সন্তান। ছোট থেকেই আধ্যাত্মিকতায় ঝোঁক। নগেন্দ্র আশ্রমে তিন বছর ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। মা-বাবার মৃত্যুর পরে আশ্রম ত্যাগ। কিন্তু তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা হয়েই রাজনৈতিক জুলুমে রবীন্দ্রভারতীর এমএ পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
২০০০এ বিয়ে। মুম্বইয়ে কর্পোরেটের চাকরি। মেয়ের জন্মের কয়েক মাসেই চাকরি ছেড়ে ২০০৭এ টলিউডে হিরো হিসেবে আত্মপ্রকাশ। তৃণমূল সংসর্গ। তৃণমূল যুব কংগ্রেসে কার্যকরী সভাপতি। টেলিকম ও প্লেসমেন্টে নিজের ব্যবসা। কিন্তু সুর কাটছিল তিন বছর ধরেই। হিরণ বলেন, “চোরেদের সঙ্গে কী থাকব! আমার ফোন দেখিয়ে দেব, তিন বছরে অভিষেক একটাও মেসেজের জবাব দেননি। দল খালি বলেছে, অমুকের প্রচারে যাও! বিজেপি সম্মান দিয়েছে।” তবে ভোটের আগে বিজেপিভুক্ত নেতা বলতে ভুলছেন না, “আমি দীনদয়াল উপাধ্যায়ের বই পড়ে বিজেপি। আশ্রমের ব্রহ্মচারী থেকে হিরো হয়ে রাজনীতি, এমন মুখ আর নেই!”
সিনেমায় বছরে একটির বেশি ছবিতে তাঁর 'লোভ' নেই। যদিও সেটাই না কি হিট করে। এখন মানুষের সেবাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য, বলছেন হিরন্ময়। খড়্গপুরে হোটেল বা ‘দিলীপদা’র বাংলোয় মিশিয়ে থাকছেন। তাঁর দাবি, “উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয়ী প্রার্থী প্রদীপ সরকারই এখন ব্যাকফুটে। রোজ রাত তিনটে অবধি মিটিং করে ওদের সব মেশিনারি আমি টেনে নিয়েছি।”
খড়্গপুরে মোদী-শাহ দু'জনেই তাঁর হয়ে পথে নেমেছেন। তবু প্রচারের শেষবেলায় নায়কের নাওয়াখাওয়া এখন মাথায় উঠেছে।