শহরে প্রবীণ নাগরিকদের অনেকেই একা থাকেন এবং জীবনযাপনের অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অন্যের উপরে নির্ভর করতে হয়। নিজস্ব চিত্র।
‘‘এ বারই হয়তো শেষ ভোট দিলাম, তোমাকে অনেক আশীর্বাদ করি...।’’
সরকারি কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালনে গিয়ে এমন কথা শুনে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন ভোটকর্মী শ্রীরূপা ঠাকুর। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে প্রবীণ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দমদম এলাকায় ওই কাজ করতে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘এমন অনেকে আছেন, যাঁরা এই ব্যবস্থা না হলে ভোটকেন্দ্রে যেতেই পারতেন না। অনেকেই বার বার আমাদের সে কথা জানিয়েছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন।’’
কেবল দমদম নয়, প্রবীণদের এমন অভিজ্ঞতার খবর মিলেছে শহরের অন্যত্রও। অনেকেই জানিয়েছেন, একে করোনা পরিস্থিতি, তার উপরে গরম। সব মিলিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে লাইন দিয়ে ভোট দেওয়া সম্ভব ছিল না। অনেকে আবার শয্যাশায়ী। তাঁরাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পেরে খুশি। গোপনীয়তা রক্ষা করেই ভোটগ্রহণ হয়েছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।
যাদবপুর কেন্দ্রের ভোটার, অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী কীর্তিমান গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী মিনতিদেবী, দু’জনেই বাড়ি থেকে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়েছেন। কীর্তিমানবাবু বললেন, ‘‘আমাদের দু’জনেরই বয়স আশির বেশি। আমি হয়তো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার স্ত্রীর যা শারীরিক অবস্থা, তাতে তাঁর পক্ষে যাওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না। এই ব্যবস্থায় আমাদের মতো অনেকে ভোটটা দিতে পেরেছেন।’’ অজয়নগরের বাসিন্দা, নবতিপর অমল মজুমদারও জানালেন, বাড়িতে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা না থাকলে এ বছর তাঁর পক্ষে ভোট দেওয়াই সম্ভব হত না। তাঁর কথায়, ‘‘যা ব্যবস্থা আমাদের জন্য করা হয়েছিল, তাতে আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনেই খুশি।’’ ভোটকর্মীদের অনেকে জানাচ্ছেন, এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য প্রবীণ ভোটারেরা সকলেই উন্মুখ হয়ে ছিলেন। এক ভোটকর্মীর কথায়, ‘‘গিয়ে দেখেছি, সকলেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন।’’
মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, শহরে প্রবীণ নাগরিকদের অনেকেই একা থাকেন এবং জীবনযাপনের অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অন্যের উপরে নির্ভর করতে হয়। ভোট দেওয়ার মতো ব্যাপার তাঁদের কাছে স্বাধীন মত প্রকাশ ও স্বনির্ভরতার একটা প্রতীক। তা না করতে পারলে অনেকে মানসিক ভাবে ভেঙেও পড়েন। এমনই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন দমদমের বাসিন্দা, নবতিপর এক মহিলা। বছর দশেক আগে ভাইঝির সঙ্গে ভোট দিতে গিয়ে তিনি দেখেন, ভোটার তালিকায় তাঁর নাম নেই। অথচ, ভোটার স্লিপ তিনি পেয়েছিলেন! ভোট দিতে না পারার আক্ষেপে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার দেশ আমাকে ত্যাগ করল!’’
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এক জন নাগরিকের পক্ষে চলাফেরা করা সম্ভব নয় বলে তাঁর নাগরিক অধিকারবোধও অন্তরায়ের মুখে পড়বে, এমনটা কাম্য নয়। তাই কেবল না আসতে পারার কারণে ভোট দিতে না পারলে তাঁরা আরও উপেক্ষিত বোধ করতেন। এটা খুবই ইতিবাচক যে, এ বার এই পদ্ধতি শুরু হয়েছে।’’ তাঁর মতে, কেবল ভোটদান নয়, করোনার প্রতিষেধক পাওয়ার মতো নানা ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা চালু করা উচিত।
বছর দশেক আগে ভোট দিতে না পারলেও ফের ভোটার তালিকায় নাম তোলার পরে এ বছর ভোট দিয়েছেন দমদমের বাসিন্দা, বছর পঁচানব্বইয়ের ওই প্রবীণা। পোস্টাল ব্যালট খামবন্দি করেছেন নিজেই। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় খুশি হলেও এ বার তাঁর মতো অনেকেরই মৃদু অনুযোগ, হাতে ভোটের কালিটা লাগল না!