প্রতীকী চিত্র
উত্তর কলকাতার ক্যানাল ইস্ট রোডে খালপাড় সংলগ্ন বিশাল বটগাছ। গাছের নীচের অংশ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে দিনভর চলে তাসের আসর। রাত বাড়লে সেটাই আবার নেশাগ্রস্তদের ঘুমের ঠিকানা। পুরসভার খাতায় নির্দিষ্ট কোনও নম্বর না থাকা সেই ঠিকানাই নাকি ৮০ বছরের পুরনো ক্লাব! নাম ‘রেড স্টার’।
তবে এই ক্লাবের সভাপতি বা সম্পাদক কে, তা কেউ জানেন না। জানা নেই ক্লাবের সদস্যই বা কারা। যদিও বছর বছর এই ক্লাবের নামেই সরকারি টাকা এসেছে বলে উল্লেখ রয়েছে রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের খাতায়। সেই টাকার হিসেব দেওয়ারও কেউ নেই। মানিকতলা থানার পুলিশের কাছে থাকা একটি কাগজে অবশ্য ক্লাবের মাথা হিসেবে সই রয়েছে এক ব্যক্তির। সদ্য দল পাল্টে তিনিই এখন এলাকায় ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের দাবি তুলে কথা বলছেন।
সরকারি খয়রাতির টাকায় কী কী সামাজিক কাজ করলেন? ঘর না বানিয়ে বটতলাতেই ক্লাব রয়ে গেল কেন? প্রশ্ন শুনে অত্যন্ত বিরক্ত ওই নেতা বললেন, “ক্লাবের ঘর হবে কী করে? সরকার দিচ্ছে বলে যারা টাকা দিয়েছিল, তারাই তো সরকারে থাকা দলের প্রচারের কাজে ওই টাকা খরচ করাল। পরে বুঝতে পেরে সরে এসেছি।” কিন্তু কোনও নথি না থাকা বটতলার এমন ‘ক্লাব’ টাকা পেল কী করে? কী করেই বা দেখানো হল তিন বছরের অডিট রিপোর্ট? স্থানীয়
বিধায়ক বা কাউন্সিলরের সুপারিশপত্রই বা পাওয়া গেল কী ভাবে? এ বার নেতার ছোট্ট উত্তর, “আগে সব সেটিং ছিল।’’
এই ‘সেটিংয়ের’ জোরেই ক্লাবগুলিকে দেওয়া খয়রাতির টাকা নয়ছয় হয়েছে বলে অতীতে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। রাতারাতি ভুয়ো ক্লাব তৈরি করে টাকা হাতানোর কথা যেমন শোনা গিয়েছিল, তেমনই ক্লাবের নামে আসা এই সরকারি টাকা স্থানীয় নেতারা পকেটে পুরছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। গত লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছিল, দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হওয়া ছাড়া ক্লাবগুলোকে টাকা দিয়ে লাভ কী হল?
ভোটবাক্সেও তো সে ভাবে এই অর্থসাহায্যের প্রতিফলন দেখা গেল না! ভোটমুখী বঙ্গে এই মুহূর্তে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কাটছাঁট করে দেওয়া টাকা যে ক্লাবগুলিকে ফি-বছর পাইয়ে দিলেন বিধায়ক-কাউন্সিলরেরা, এখন সেই ক্লাবগুলো তাঁদের সঙ্গে আছে তো? পাড়ায় পাড়ায় খোঁজ করে অবশ্য জানা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও তাঁদের বিঁধছে সেটিংয়ের জোরে অযোগ্যদের টাকা পাইয়ে দেওয়ার ‘অন্যায়’।
প্রশাসন সূত্রেই খবর, কলকাতার প্রায় ১০৫০টি ক্লাবকে আর্থিক অনুদান দিতে খরচ হয়েছিল অন্তত ১২২ কোটি টাকা। এই তালিকায় সব চেয়ে বেশি ক্লাব ছিল টালিগঞ্জ, বালিগঞ্জ এবং যাদবপুর অঞ্চলের। এর পরে ছিল ভবানীপুর, বেহালা ও পর্ণশ্রী এলাকার বিভিন্ন ক্লাব। ২০১৬-’১৭ সাল থেকে ক্লাব খয়রাতির তালিকার শীর্ষে উঠে আসে চেতলা, গড়িয়াহাট এবং চৌরঙ্গি চত্বর। উত্তর ও পূর্ব কলকাতার ক্লাবগুলি তালিকায় পিছনের দিকে থাকলেও ভুয়ো ক্লাব ঘিরে অভিযোগ সব চেয়ে বেশি এসেছিল পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব কলকাতা থেকে। জেলার ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ আধিকারিকেরা দাবি করেছিলেন, মন্ত্রী, বিধায়ক বা সাংসদের সুপারিশপত্রের জোরে কে, কোথা থেকে টাকা নিয়ে নিচ্ছেন, তা তাঁরা জানতেই পারছেন না।
২০১৬-’১৭ বর্ষে এমন প্রায় ১৬০টি ক্লাব টাকা নিয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে, যাদের কোনও অস্তিত্বই নেই! এমনও ঘটেছে, পাড়ার যে ক্লাব সারা বছর ক্রীড়া ক্ষেত্রে কাজ করে, তারা টাকা পায়নি। অথচ পাশের এমন ক্লাব টাকা পেয়েছে যারা স্রেফ জলসা আয়োজন করেই সামাজিক কর্তব্য পালন করে।
আমহার্স্ট স্ট্রিটের এমনই একটি ভুক্তভোগী ক্লাবের কর্মকর্তা বললেন, “কালীপুজোর জন্য আমরা বিখ্যাত। এই অপরাধে আমাদের টাকা দেওয়া হয়নি। সারা বছর ধরে করা জনসেবামূলক কাজ পাত্তাই পায়নি, আমরা নেতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের না হওয়ায়।’’ হেস্টিংসের একটি ক্লাবের কর্মকর্তার আবার মন্তব্য, “ক্লাবের একটি সামাজিক কর্মসূচিতে কাউন্সিলরকে ডেকেছিলাম। সেই রাগে বিধায়ক টাকা আটকে দিয়েছিলেন।’’ নেতাজিনগরের একটি ক্লাবের কর্তা আবার বলছেন, “চোর কি চুরি করে গৃহস্থের উপরে কৃতজ্ঞতা দেখায়? ক্লাবের নামে যে টাকা এসেছে, সেটাও বহু জায়গায় বারো ভূতে চুরি করে খেয়েছে। শুধু ভোটবাক্সে কেন, কোথাওই কৃতজ্ঞতা থাকার কথা নয়।”
চলতি বিধানসভা ভোটে কি তবে খয়রাতির ফলাফল শূন্য? উত্তর মিলতে আর এক মাস।