মাছে-ভাতে বাঙালি: চার দশক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন। কর্মসূত্রে বিশ্বের উন্নততর দেশেও গিয়েছেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেই ভেতো বাঙালিই রয়ে গিয়েছেন। এখনও যদি কেউ প্রশ্ন করেন পছন্দের খাবার নিয়ে। হাসি মুখে জবাব দেন, ‘‘ভাত আর মাছের ঝোল হলেই আমি খুশি।’’
ভোট কিন্তু যুদ্ধ নয়: রাসবিহারী জয়ের লড়াইয়ে নেমেছেন। কিন্তু ভোটকে যুদ্ধ বলে মনে করেন না প্রাক্তন সেনাকর্তা। বলেন, ‘‘যুদ্ধ তো শত্রুদের সঙ্গে হয়। এখানে তো সকলেই আমাদের নিজের লোক। কারও সঙ্গেই যুদ্ধ করতে আসিনি।’’ রাজনীতি তাঁর মতে জনসেবার একটা পন্থা। বামফ্রন্টের ৩৪ বছর এবং তৃণমূলের ১০ বছরের আসনকাল দেখে সিদ্ধান্ত নিতে বলছেন রাসবিহারীর ভোটারদের। ফৌজির মতো মনে করছেন, বেশিরভাগ মানুষ যাঁকে বেছে নেবেন, তিনিই জয়ী হবেন।
রণ-বীর সিংহ: সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান থাকাকালীন ২০১৬ সালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছিল পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে। সেই অপারেশনের জন্য গোটা বিশ্ব ভারতীয় সেনাকে কুর্নিশ জানিয়েছিল। সেই সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এই সেনা আধিকারিক। বিজেপি সমর্থক এবং কর্মীদের মুখে ঘুরেফিরে আসছে তাঁর সেই কৃতিত্বের কথা। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত রণ-বীর সে প্রসঙ্গে এড়িয়েই প্রচার করছেন।
ঘড়ির কাঁটা: সেনাবাহিনীর আদবকায়দা জনসমক্ষে একেবারেই দেখান না। মিলিটারি সুলভ চড়া মেজাজও নেই। প্রচারে বেরিয়ে কর্মজীবনের কথা মুখে আনেন না। কেউ জানতে চাইলে সংক্ষেপে পরিচয় দেন। কিন্তু কথা ও সময় মেপে কাজ করাটা মজ্জাগত। প্রচারে কোথাও এক মিনিট দেরিতে পৌঁছন না। আবার এক মিনিট অতিরিক্ত সময়ও ব্যয় করেন না। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা— ঘড়ির কাঁটায় মাপা জীবন।
মনের মানুষ: ভোটের প্রচারে কাজে লাগছে সেনাবাহিনীতে শেখা কৌশল— নো ইওর ম্যান। নিজের লোককে চিনে নাও। সুব্রতের প্রচারের অগ্রভাগে দেখা যাচ্ছে যুবক ও মহিলাদের। কাকে কী দায়িত্ব দিতে হবে, কার থেকে কী দায়িত্ব আদায় করে নিতে হবে, ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছেন। ভোটের দিন কোন বুথে কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা-ও যোগ্যতা বুঝেই স্থির করছেন। বলছেন, ‘‘আমাদের সেনাবাহিনীতে শেখানো হয়, ‘টু নো ইওর ম্যান’। যদি নিজের দলকেই না চিনতে পারি, তা হলে আর ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব কীভাবে!’’
পোস্টারবয়: ফৌজে থাকাকালীন আত্মনির্ভরতায় জোর দেওয়ার জন্য তাঁকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের পোস্টারবয় বলা হয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প চালু করেছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই ডিসিওএএস এবং ডিজি সিআইডিএম ১,০০০-এর উপর শিল্পসংস্থাকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া–ডিফেন্স’ প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজনীতিশ্রুতি— ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের তাঁর ভূমিকার জন্যই মোদীর নজরে এসেছিলেন সুব্রত।
আ-মোদীত: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীতে আমোদিত তিনি। ফলে প্রচারেও সঙ্গে রাখছেন মোদীর ছবি। ফৌজি পোশাক অনেক আগেই ছেড়ে এসেছেন। ভোটের প্রচারে নিজের ‘ড্রেস কোড’ নিজেই ঠিক করে নিয়েছেন— সাদা হাফহাতা শার্ট আর হালকা রংয়ের ট্রাউজার্স। পায়ে স্নিকার্স। মুখে আবশ্যিক দু’টি মাস্ক। মাঝে মাঝে সঙ্গীদের থেকে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া। গলায় বিজেপি-র উত্তরীয়। যেখানে পদ্ম প্রতীকের সঙ্গেই রয়েছে মোদীর ছবি।
জল কে চল: প্রচারে বেরিয়ে জল ছাড়া অন্য কিছুতে ভরসা নেই। দলীয় কার্যালয় বা কর্মীদের বাড়িতে সরবৎ, নরম পানীয়ের প্রস্তাব সযত্নে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘ভোট প্রচারে অন্য কিছু খেলে শরীর খারাপ হতে পারে। তাই শুদ্ধ জলেই আগাগোড়া ভরসা রেখেছি। শুরু থেকে সেই ভাবেই চলছি।’’ সঙ্গীদের কাছে থাকছে মিনারেল ওয়াটারের বোতল। চেয়ে নিয়ে প্রবল গরমে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন মাঝেমধ্যেই।
প্রথম আদি তব শক্তি: প্রচারে নেমে সবচেয়ে বেশি সুব্রতের নজর টেনেছে আদিগঙ্গার বেহাল পরিস্থিতি। বলছেন, ‘‘রাসবিহারী কলকাতা শহরের অন্যতম কেন্দ্র। সেখানে আদিগঙ্গার করুণ হাল দেখে সত্যিই দুঃখ হয়। বিজেপি ক্ষমতায় এলে ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে আদিগঙ্গার হালও ফেরাতে চাই।’’ শুধু অপরিচ্ছন্ন আদিগঙ্গা তাঁকে চিন্তিত করেছে, তা-ই নয়। সেই জলধারার আশেপাশে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য নিয়েও উদ্বিগ্ন সুব্রত। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনান্ট জেনারেল বলছেন, ‘‘ওইসব এলাকায় বাচ্চারা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াতে মারা যাচ্ছে। এই জন্যই আসল পরিবর্তন জরুরি!’’
শিলংয়ে নয়, কাশ্মীরে: সরাসরি ভোট লড়ে নামা এই প্রথম। কিন্তু বিধানসভা ভোট সামলেছেন। ২০১৪ সালে কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের জন্য সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত। শ্লাঘার সঙ্গে দাবি করেন, সেই ভোটে কাশ্মীরে সবচেয়ে বেশি ভোটগ্রহণ হয়েছিল। আর ভোট হয়েছিল সম্পূর্ণ নিরুপদ্রব এবং শান্তিপূর্ণ।
খেলা হবে: খেলাধুলো বরাবর পছন্দের। কারণ, খেলাধুলো স্বাস্থ্য গড়ে। প্রচারে নেমে রাসবিহারী এলাকার বড় মাঠে নজর গিয়েছে তাঁর। খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, বহু কৃতী ক্রীড়াবিদের বাস রাসবিহারীতে। বাস্কেটবল থেকে ফুটবল। টেনিস থেকে ক্রিকেট। সবক্ষেত্রেই প্রতিভা লুকিয়ে আছে নাকি রাসবিহারীতেই। কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ কম। তাই জয়ী হলে রাসবিহারীর ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে চান।
এত্তা জঞ্জাল: প্রচারে বেরিয়ে সুব্রতের চোখে পড়েছে শহরের আকাশ ঢাকা পড়েছে তারের জঙ্গলে। সেই বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে যে কোনওদিন বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন প্রাক্তন ফৌজি। বলেন, কোনও উন্নয়নশীল দেশেও এমন তারের জঞ্জাল থাকে না। দেখতে খারাপ আর ঝুঁকিপূর্ণ। রাসবিহারী-সহ গোটা কলকাতা থেকেই তারের আগাছা নির্মূল করতে চান।
ছাড়াছাড়ি নেই: সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় শেখানো হয়, ‘আ সোলজার নেভার কুইট্স টিল হি ইজ ডেড’। একজন ফৌজি মৃত্যু না হওয়া পর্যন্তরণক্ষেত্রে ছেড়ে যায় না। সুব্রত বিশ্বাস করেন, সেনাদের অবসর বলে কিছু হয় না। দুই পুত্র কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন। বাড়িতে স্ত্রী আছেন। অবসর কাটাতে পারতেন আরামে। কিন্তু দেশ ও দশের কাজ করতে চেয়েছিলেন। তাই বিজেপি-তে যোগদান। অবশেষে ভোটে দাড়ানো। কর্মী-সমর্থকরা নিশ্চিত, তাঁদের ‘যোদ্ধা প্রার্থী’ জিতবেনই।
তথ্য: অমিত রায়, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী