গুপ্তিপাড়ার বাড়িতে বন্দনা ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র।
ওই ডাকটা তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিতই ছিল। শোনার পর থেকে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না হুগলির গুপ্তিপাড়ার ষাটোর্ধ্ব বন্দনা ভট্টাচার্য। কত যে স্মৃতি ভিড় করে আসছে!
প্রায় ১০ বছর তাঁদের দেখা নেই। কথা নেই। কিন্তু বৃহস্পতিবার গুপ্তিপাড়ায় জনসভা করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চ থেকে যে আচমকা ‘বুলু এসেছে কি’ বলে হাঁক দেবেন, ভাবতে পারছেন না বন্দনাদেবী। তিনিই মমতার ভালবাসার ‘বুলু’। যিনি কখনও কখনও মমতার কাছে ‘টিয়া’ও হয়ে যেতেন!
জনসভায় মুখ্যমন্ত্রীর ওই হাঁক শুনে সবাই তখন এ দিক-ও দিক তাকাচ্ছিলেন। মমতাই খোলসা করেন, ‘‘আমার পাড়ার মেয়ে বুলু। আমার সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করত। এখানে বিয়ে হয়েছে।’’
গুপ্তিপাড়ার বৈদিকপাড়ায় এক ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতিকে নিয়ে থাকেন বন্দনাদেবী। মাস সাতেক আগে স্বামী আশিসবাবু মারা গিয়েছেন। পায়ের ব্যথার জন্য বাড়ি থেকে বিশেষ বার হন না বৃদ্ধা। তাই বৃহস্পতিবার ওই সভায় যাননি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তাঁর খোঁজ নিয়েছেন শুনে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ২৪ ঘণ্টা পরে, শুক্রবার বন্দনাদেবীর কথায় সেই ভাল লাগার রেশ।
‘‘দিদি আমায় ভালবেসে বুলু বলে ডাকতেন। কখনও-সখনও টিয়াও বলতেন। কারণ, আমার নাকটা টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো। এক সময়ে একসঙ্গে কত কিছু করেছি! কত জায়গায় গিয়েছি! কত গল্প করেছি! আমার খুব ইচ্ছে, দিদি আমায় একবার ডাকুন। আমরা আবার কিছুক্ষণ একসঙ্গে কাটাতে পারব।’’— এটুকুই আবদার বন্দনাদেবীর।
বৃদ্ধার বাপের বাড়ি গুপ্তিপাড়া লাগোয়া পূর্ব বর্ধমানের পূর্ব সাতগেছিয়ায়। মামার বাড়ি কলকাতার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। তার কয়েকটা বাড়ি পরেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি। কলেজবেলায় মামাবাড়িতেই বেশি থাকতেন তিনি। তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ ১৯৮২-তে।
বন্দনাদেবীর স্মৃতি এখনও টাটকা, ‘‘মামাবাড়ির এক পড়শি সিপিএম করতেন। কিন্তু মমতাদিকে খুব ভালবাসতেন। তাঁর সঙ্গেই একদিন দিদির টালির চালের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ গল্প করি। তার পর থেকে মাঝেমধ্যেই যেতাম। যাতায়াত অবাধ হয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে আমি যেন দিদির পরিবারের এক সদস্য হয়ে উঠেছিলাম! দিদির মা আমাকে খুব ভালবাসতেন। একসঙ্গে পিকনিক করা, ঘুরতে যাওয়া, চপ-মুড়ি খাওয়া— কিছুই বাদ ছিল না। কংগ্রেসের হয়ে মিটিং-মিছিলও করতাম একসঙ্গে।’’
সেই আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বছর চারেক একটি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন, সে কথাও ভোলেননি বন্দনাদেবী। তাঁর স্মৃতি বলছে, ‘‘হঠাৎ একদিন দিদি বললেন, এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য একটি স্কুল করতে হবে। দিদির সঙ্গে আমরা চার জন ঝাপিয়ে পড়লাম। কালীঘাটে ‘হিন্দু মিশন’ নামে একটি স্কুল খুলে বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলাম। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হত। চার বছর স্কুলটা চালিয়েছিলাম। দিদি ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। আমরা সহ-শিক্ষিকা।’’
এ ভাবেই তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে আসে মমতার মাধ্যমে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ও রাজীব গাঁধীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা। আফসোস, দিদির সঙ্গে কাটানো সময়ের ছবি একটিও বন্দনাদেবীর কাছে নেই। সবই দিদির কাছে আছে বলে জানান।
বছর দশেক আগে শেষবার কালীঘাটে মমতার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। অসুস্থ মুখ্যমন্ত্রীর মাকে দেখতে। তার পরে আর দেখা-কথা হয়নি। বন্দনাদেবী বলেন, ‘‘দিদির ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। তাই ফোন করতে পারি না। পরেও অবশ্য ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা ঢুকতে দেননি। ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রও গিয়ে দিতে পারিনি একই কারণে।’’
বৃহস্পতিবারের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, বুলুদেবীকে যেন মঞ্চে আসতে দেওয়া হয়। বন্দনাদেবী চান, মঞ্চে নয়, অন্য কোথাও আরও একবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা দিতে। ঠিক আগের মতো। যেখানে নিরাপত্তারক্ষীদের ‘না’থাকবে না।