নির্বাচনী রাজনীতি ঘিরে শিশুদের উপরে আঘাত আসা ক্রমেই বাড়ছে। আগে ঘটেছিল হালিশহরে, শনিবার রাতে ভোট মিটতেই একই রকম ঘটনার অভিযোগ এল বালিগঞ্জ থানার বেলতলা রোডে পেয়ারাবাগান বস্তি এবং হরিদেবপুর এলাকা থেকে।
অভিযোগ, ওই রাতে পেয়ারাবাগানে কংগ্রেসের এক এজেন্টের বাড়িতে হামলা হয়। তাঁকে না পেয়ে তাঁর ভাসুরের মেয়েকে শূন্যে তুলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। মারধর করা হয় বাড়ির অন্যদেরও। এই ঘটনায় আক্রান্ত সাড়ে ছ’বছরের ওই শিশুর নাম ঈশানী পাত্র। তার কাকিমা স্মিতা পাত্র বালিগঞ্জ কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী কৃষ্ণা দেবনাথের ২৫২ নম্বর বুথের পোলিং এজেন্ট ছিলেন। অভিযোগ, তাঁকে ‘শিক্ষা’ দিতেই এসেছিল প্রায় ৫০ জনের দল। স্মিতাদেবীকে না পেয়ে রোষ গিয়ে পড়ে ছোট্ট মেয়েটির উপরে। পুলিশে এমনই অভিযোগ করা হয়েছে ওই পরিবারের তরফে। একই রাতে হরিদেবপুর থানা এলাকায় প্রীতি বর নামে দশ বছরের আর এক শিশুকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শাসকদলের সমর্থক কিছু যুবকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, প্রীতির বাবা ও দাদু শাসকদলের লোকজনের হুমকি উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিলেন বলেই এই হামলা।
ঈশানীর পরিবারের অভিযোগ, বাড়িতে ঢুকে হাতের সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই মারধর করে দুষ্কৃতীরা। প্রথমে ঈশানীর বাবা তপন পাত্রকে ঘুষি মারতে থাকে ওই ছেলেরা। মায়ের পায়ের কাছে শাড়ি আঁকড়ে ধরা, ভয়ে কুঁকড়ে থাকা ঈশানী তখন চিৎকার করে ওঠে। এর পরেই রোষের মুখে পড়ে যায় ঈশানী। একটা পুরুষালি হাত এসে পিছন থেকে তুলে তাকে ছুড়ে দেয় ঘরের কোণে।
প্রীতি বর।
পরিবারের অভিযোগ, ওই ঘটনায় ঈশানী হাত-পায়ে চোট পেয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি চোট লেগেছে ওর মনে। গত রাতের আতঙ্কটা সঙ্গে নিয়েই রবিবার সকাল থেকে বেশ কয়েক বার বিবর্ণ মুখে মায়ের কাছে প্রশ্ন করে চলেছে, ‘‘রাত হলেই আবার ওরা আসবে না তো?’’ রবিবার ঈশানীর অভিযোগ, ‘‘অনেকগুলো কাকু একসঙ্গে ঘরে ঢোকে। ওরা পিছন থেকে জামাটা টেনে আমায় তুলে ধরল। তার পরে ছুড়ে ফেলে দিল।’’
বিরোধীদের অভিযোগ অনুযায়ী, শনিবার ভোট-পর্ব মিটতেই তাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে এ ভাবে শাসকদলের লোকেরা হামলা চালায়। আরও অভিযোগ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করানোর জন্য যে পুলিশ প্রশংসা আদায় করেছে, ভোট মিটতেই ফিরেছে তাদের পুরনো চেহারা। বিরোধীদের বক্তব্য, ঈশানীর বাড়িতে যারা চড়াও হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে রাতেই থানায় অভিযোগ দায়ের করতে যান এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর ও কংগ্রেস নেত্রী মানিলা চৌধুরী। তাঁর অভিযোগ, বালিগঞ্জ থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে তিনি দেখেন, থানা চত্বরেই বসে আছেন অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা নারায়ণ জানা, ভরত জানা ও তাঁর দলবল। মানিলাদেবীর অভিযোগ, পুলিশের সামনেই তাঁর উপরেও হামলা হয়। কিন্তু পুলিশের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের।
এ দিন ঈশানীর মা অভিযোগ করেন, ঘর থেকে তাঁর স্বামী ও মেয়েকে ধাক্কা মেরে বার করে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টাও হয়। চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ঈশানীর কাকা, স্মিতার স্বামী স্বপনবাবু। ঘরের কোণে স্ত্রীকে মুখ বেঁধে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কেউ যাতে টের না পায়। অভিযোগ, স্বপনবাবুকেও বেধড়ক মারতে শুরু করে যুবকেরা। স্বপবনবাবু এখন এসএসকেএমে ভর্তি। রবিবার স্মিতাদেবী বলেন, ‘‘আমায় না পেয়েই ওরা স্বপনকে মারে। স্বপন আমায় বারবার বলেছিল, তুমি বাইরে এসো না। ওরা মেরে ফেলবে।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, শুধু মারধর করা নয়, ঘরের জিনিসও ভাঙচুর করা হয়। স্মিতাদেবীর দাবি, তিনি লুকিয়ে দেখেছিলেন, যারা তাঁদের উপরে আক্রমণ চালিয়েছে তাদের হাতে পিস্তল, লাঠি-সহ বেশ কিছু ধারালো অস্ত্র ছিল। তাঁর আরও অভিযোগ, বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের ছেলেরা বারবার বলছিল, ‘‘কংগ্রেসের এজেন্ট হয়েছিস তো, তোকে এ বার কেটে ফেলব।’’
এলাকার সিপিএম নেতা পূর্ণেন্দু ঘোষ বলেন, ‘‘এই ঘটনার শেষ দেখতে চাই। একটা বাচ্চার উপরে অত্যাচার কিছুতেই মেনে নেব না।’’ মানিলাদেবীর অভিযোগ নিয়ে কিছুই বলতে চাননি বালিগঞ্জ থানার পুলিশ কর্তারা। তবে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায় রবিবার বলেন, ‘‘গতকাল রাতে হলেও ঘটনাটি আমি আজ সকালে জেনেছি। পুলিশকে বলেছি, দোষীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ সেই দাবি তুলেই এ দিন সন্ধ্যায় জোট প্রার্থী কৃষ্ণা দেবনাথের সঙ্গে বালিগঞ্জ থানায় স্মারকলিপি জমা দেন এলাকায় জোটের সমর্থকেরা।
এ দিকে রবিবার সারা দিন হরিদেবপুর থানা এলাকায় প্রীতির ঘটনা নিয়েও চলে তোলপাড়। অভিযোগ, শনিবার রাতে তৃণমূল কর্মীরা বাড়িতে প্রীতির বাবা দীনেশ বরকে না পেয়ে হামলা চালায় প্রীতির উপরে। লাঠির ঘায়ে ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে তার কপাল। কপালে ব্যান্ডেজ নিয়ে ছলছলে চোখে প্রীতির প্রশ্ন, ‘‘বাবা, দাদু ভোট দিল, তাই ওরা আমায় মারল? আচ্ছা, ভোট দিলে মারে কেন?’’ এই ঘটনার বিষয়ে বেহালা (পূর্ব) কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘একটি শিশুর আহত হওয়া নিয়ে যে ভাবে রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এতে মোটেও তৃণমূল জড়িত নয়। এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোমবার ওই এলাকায় প্রতিবাদ সভা করা হবে। এই নিয়ে কোনও রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নিতে চাই না।’’ যদিও শোভনবাবু মেনে নিয়েছেন, ওই জায়গায় সে দিন তৃণমূল এবং সিপিএমের বচসা-বিবাদ হয়েছিল। বলেন, ‘‘ওখানে সিপিএম-তৃণমূলে একটা তর্কাতর্কি হয়েছিল।’’
— নিজস্ব চিত্র।