ভিড় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ চেষ্টা পুলিশের। (ইনসেটে) ভিড় নলহাটিতেও।
সভামঞ্চে হাজির ত্রিমূর্তি। তারপরেও পণ্ড হল সভা!
প্রথম জন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়, দ্বিতীয় জন অনুব্রত মণ্ডল এবং তৃতীয় জন দীপক অধিকারী ওরফে তারকা সাংসদ দেব। বিরোধীদের দাবি, ত্রিমূর্তি এক মঞ্চে থেকেও ভিড় সামাল দিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, প্রবল ভিড়ে যে কোনও মুহূর্তে বড়সড় বিপদও হয়ে যেতে পারত! ‘‘তার দায় কে নিত?’’— সে প্রশ্নও তুলছেন সিপিএম নেতারা।
বস্তুত, ভিড়ের চাপে ভেস্তে গেল দেবের নির্বাচনী সভা। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে সভাস্থল ছাড়তে বাধ্য হলেন দেব। শুক্রবার ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া স্কুল মাঠে অভিজিৎ রায়ের সমর্থনে সভা ছিল দেবের। কয়েক দিন ধরে প্রচারের পাশাপাশি লোকের মুখে মুখে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। দেবকে দেখার জন্য এ দিন সভাস্থলে যাওয়ার জন্য কাজ সেরে রেখেছিলেন গৃহবধূ, দিনমজুর থেকে স্কুল পড়ুয়ারাও। দিনের শেষে সকলকে কার্যত হতাশ হয়েই ফিরতে হল।
প্রশাসন এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন বেলা দু’টোর সময় সভা শুরুর কথা ছিল। সেই মতো বেলা একটা থেকেই সভাস্থলে লোক জমতে শুরু করে। ভোটের কাজে প্রশাসন অধিকাংশ বাস তুলে নেওয়ায় বেশির মানুষজন হেঁটে সভাস্থলে আসেন। কাছাকাছিই মুর্শিদাবাদ জেলা। সেখান থেকেও অনেক লোক আসেন। ছাতা মাথায়, গামছা মাথায়, কাউকে কাউকে খালি মাথায় চড়া রোদ উপেক্ষা করে অপেক্ষা করতে দেখা গিয়েছে। কোথাও শব্দ পেলেই কপালে হাত রেখে আকাশের দিকে চোখ ফেরাচ্ছিলেন অনেকে।
এক সময় হেলিপ্যাডের কাছে ধোঁয়া উঠতে দেখেই সকলে ‘ওই আসছে, ওই আসছে’ বলে শোরগোল ফেলে দেয়। বেলা তখন ৩টে ২০। কপ্টার থেকে নামেন দেব। সঙ্গে মুকুল রায়। তারই কিছুটা আগে মঞ্চে পৌঁছন অনুব্রত মণ্ডল। দেব মঞ্চে উঠতেই তাঁকে কাছ থেকে দেখার জন্য, একটু ছোঁওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ভিড় ঠেলে সবাই মঞ্চের কাছে পৌঁছতে নিজেদের মধ্য ঠেলাঠেলি শুরু করে দেন। উদগ্রীব জনতাকে সামাল দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যান স্বেচ্ছাসেবক, তৃণমূলকর্মী এমনকী পুলিশকর্মীরাও।
মাইক্রোফোন হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন অনুব্রত। কিন্তু কে শোনে, কার কথা! এক সময় দেব মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনারা কী চান? আমি চলে যাই? সঙ্গে সঙ্গে জনতা চিৎকার করে ওঠে। কী যে তাঁরা বলেন, বুঝতে পারেননি অনেকেই। কিন্তু ঠেলাঠেলি চলতেই থাকে। মঞ্চ কংক্রিটের হওয়ায় সেখানে দেব-সহ অন্যরা সুরক্ষিত থাকলেও কার্যত ভেঙে যায় বাঁশের পলকা ব্যারিকেড। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত জায়গার দখল নেয় পুরুষেরা। ছেলে কোলে বহু মহিলাকে ফাঁকা জায়গার দিকে ছুটতে দেখা যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে মিনিট দশেকের মধ্যে নিরাপত্তারক্ষী এবং পুলিশের ঘেরাটোপে কপ্টারে ওঠেন দেব এবং মুকুল রায়।
তারপরেই পাতলা হতে শুরু করে ভিড়। দেখা যায়, মাঠময় ছড়িয়ে আছে চটি-জুতো, ছাতার বাঁট, রুমাল, গামছা, ব্যারিকেডের বাঁশ। তৃণমূল কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, আর পাঁচ মিনিট দেব সভাস্থলে থাকলে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতে পারত। তৃণমূলের দাবি, অন্তত এক লক্ষ লোক হয়েছিল। পুলিশের হিসেবে, সংখ্যাটা কম করেও ৪০ হাজার। আর বিরোধীদের দাবি, লোক হয়েছিল মেরেকেটে ২৫-৩০ হাজার। তা-ও বহু লোক ছিল মুর্শিদাবাদের। এ ভাবে সভা বাতিল হওয়ায় অনেকেই চরম ক্ষুদ্ধ। বাঁধের সবিতা দাস, মনোহরপুরের অঞ্জলি ভল্লাদের প্রশ্ন, ‘‘কয়েক দিন ধরেই তৃণমূলের লোকেরা প্রচার করছিল। তা শুনে এ দিন সকাল সকাল রান্না-খাওয়া সেরে দেবকে দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু কী অবস্থায় যে পড়েছিলাম আমরাই জানি। সামাল দিতেই যখন না পারবে না তখন ঢাক পিটিয়ে লোক ডাকার কী দরকার?’’ একই অভিযোগ পেশায় গাড়ি চালক স্বপন দাস, অভিরূপ ভল্লাদেরও। তাঁরা বলছেন, ‘‘এক বেলা কাজ করে গাড়ি বন্ধ রেখে বড় আশা নিয়ে দেবকে দেখতে এসেছিলাম। সেই আশা তো মিটলই না! মাঝখান থেকে একবেলার মজুরিটা বরবাদ হল।’’
প্রশাসনের একটি সূত্রে এই ঘটনার জন্য উদ্যোক্তাদের গাফিলতিকেই দায়ী করা হয়েছে। তাঁদের মতে, অনভিজ্ঞ ডেকোরেটর দিয়ে কাজ করানো, নির্দিষ্ট সময়ে সভা শুরু না করা, প্রথম থেকেই নিয়ন্ত্রণ বজায় না রাখা, কত লোক হতে পারে সে আন্দাজ না করেই স্বেচ্ছাসেবক এবং পুলিশ কর্মী করা হয়নি বলেই ওই অবস্থা তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদার টিপ্পনি, ‘‘যাঁরা একটা সভাও সুশৃঙ্খল ভাবে করতে পারেন না, তাঁরা রাজ্য কেমন চালাবে সহজেই বোঝা যায়।’’
অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য সমস্ত গাফিলতির দায় ছেড়ে ফেলে সভামঞ্চেই জানান, মানুষের বাঁধ ভেঙে গেলে কোনও কিছু দিয়েই তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম তো ইদানীং কালে এত বড়ো জমায়েত করতে পারেনি, তাই ওই সব কথা বলতেই পারে।’’ নিরাপত্তার কথা ভেবেই সভা বাতিল করা হয়েছে, তা-ও জানিয়েছেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি।
অন্য দিকে, প্রখর রোদ উপেক্ষা করে নলহাটি পুরসভার কোঠাতলা মোড়েও দেবকে দেখতে হাজার কুড়ি লোকের জমায়েত হয়। সেই জমায়েত থেকে উড়ে এসেছে একের পর এক প্রশ্ন, আবদার। দেব উম্মুখ জনতার আবদার অনেকেই রেখেছেন। তবে তার আগে দিয়েছেন রাজ্যের উন্নয়নের ফিরস্তি। তৃণমূল শিবির জনসমাগমের বহর দেখে খুশি। প্রত্যয়ী জেতার ব্যাপারেও। জেলা সিপিএমের এক নেতার অবশ্য টিপ্পনি, ‘‘তারকা প্রার্থী এনে ওরা ভোটে জিততে পারবে না।’’ —নিজস্ব চিত্র