গোটা এলাকাটাই যেন ঘাসফুলের সাজানো বাগান।
সেই ২০০৮ সাল থেকে পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা মায় লোকসভার উপনির্বাচন— সব কিছুতেই গত কয়েক বছর ধরে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র এলাকায় ধারাবাহিক ভাবে ‘ফার্স্ট বয়’ তৃণমূল। তবু বিদায়ী বিধায়ক প্রচারে বেরিয়ে নিয়ম করে বলছেন, ‘‘কোথাও ভুলচুক হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন। পাঁচ বছরে অনেক কাজ করেছি। সুযোগ পেলে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও ভাল কাজ করব।’’
বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসের কয়েকটি প্রচার সভায় গিয়ে শোনা গেল তাঁর এমন ভাষণ। আর ভিড়ের আড়াল থেকে শোনা গেল মন্তব্য, ‘‘এ সব রঙ্গ অনেক হয়েছে। উন্নয়ন-টুন্নয়ন নয়। এ বার চাই একটু খোলা হাওয়া। চারিদিকে যেন দমবন্ধ পরিবেশ!’’ প্রার্থীর ক্ষমা চাওয়ার ধুম দেখে উঠছে এ প্রশ্নও, তা হলে কি চাপে আছে শাসক দল?
সে কথা প্রমাণে তো মরিয়া বিরোধীরা। ইছামতী সংস্কার হয়নি, যশোর রোডে যানজট কাটেনি, পুকুর ভরাট করে বেআইনি নির্মাণ গজিয়ে উঠেছে— অভিযোগ এমন নানাবিধ। তা ছাড়া, বনগাঁর নানা প্রান্তে নানা সময়ে গজিয়ে ওঠা একাধিক বেআইনি লগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে সর্বস্ব খুইয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ফলে সারদা-কাণ্ডে তৃণমূলের একাধিক হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রীর নাম জড়িয়ে পড়াকেও প্রচারে তুলে ধরছেন তাঁরা। উঠছে নারদ ঘুষ-কাণ্ডের ভিডিও ফুটেজের প্রসঙ্গও।
এত সবের মধ্যে বিশ্বজিৎবাবু অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। তবে সতর্কও। সাধারণ বুথ-স্তরের কর্মী থেকে হঠাৎই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেকনজরে পড়ে ২০১১ সালে প্রার্থী হয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। রাজনীতিতে গা-ঘামানোর তত্ত্বে বিশ্বাস রাখেন এখনও। তাই পাড়ার খুচরো অনুষ্ঠানে প্রদীপ জ্বালানোই হোক কিংবা কবিতা পাঠের আসরে ভাষণ দেওয়া— গত পাঁচ বছরে তাঁকে যত্রতত্র দেখা গিয়েছে। নিরলস জনসংযোগের কাজটা চালিয়ে গিয়েছেন। যে কারণে তৃণমূলের ‘খাস গড়’ বনগাঁতেও ঠা ঠা রোদ মাথায় নিয়ে রাত-দিন এক করে এখন দৌড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ‘ভোট পাখি’— আর যা-ই হোক, এ হেন তকমা তাঁকে দিতে পারছে না বিরোধীরাও।
ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে মার্জনা চাওয়ার পাশাপাশি উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে ফিরে আসছে আত্মবিশ্বাসী চেহারাটা। বিশ্বজিৎবাবু বলছেন, বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে এইচডিইউ, এসএনসি ইউনিট চালু করার কথা, ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান হয়েছে হাসপাতালে। শুরু হয়েছে তিনশো বেডের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির কাজ। শহরের সৌন্দর্য্যায়নের জন্য ত্রিকোণ পার্ককে সাজানো হয়েছে। অডিটোরিয়াম তৈরির কাজ শেষের দিকে। গ্রামীণ সড়কের সংস্কার বা নতুন রাস্তা তৈরি করার কথাও মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সন্ধে নামলেই যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আলোর ঝলমলানি যেন নিজেই শহরের ভোল বদলের কথা ঘোষণা করে। সাধারণ মানুষও জানাচ্ছেন, দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য নাকি কমেছে গত কয়েক বছরে।
কিন্তু তারপরেও বনগাঁ পুরভোটে কয়েক মাস আগে সন্ত্রাস, হুমকি, রিগিং, বুথ জ্যামের মতো ভুরি ভুরি অভিযোগ ওঠে। খাসতালুকে তবে কি মাটি আলগা হচ্ছে? সে কারণেই ধমক-চমকের দরকার পড়ছে? বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘তৃণমূলের সন্ত্রাস নিয়ে এলাকার লোকজন অভিযোগ করছেন বুঝি? আসলে এখানে উন্নয়ন নিয়ে সমালোচনা করার মুখ নেই বিরোধীদের।’’
বিশ্বজিৎবাবুর দাবি, যানজট সমস্যা আগের থেকে এখন অনেকটাই কম। মতিগঞ্জ এলাকায় একটি বাসস্ট্যান্ড তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া, সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাস তৈরির জন্য ৬ বিঘে জমি কেনা হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’ নদী সংস্কারের বিষয়ে তাঁর দাবি, ‘‘কালাঞ্চি থেকে টিপি পর্যন্ত ইতিমধ্যেই নদী সংস্কার হয়েছে।’’
২০১৫ সালে বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে বিজেপি দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল বনগাঁ উত্তরে। সেই ফলাফলের জোরেই প্রচারে গা ঘামাতে কসুর করছেন না বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস। এই কেন্দ্রে ২৬ শতাংশ মতুয়া ভোট আছে। মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুবাদে এলাকার মতুয়া ভোটব্যাঙ্ককে পাশে পাওয়ার ভরসাও আছে তাঁর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপানি দেবীর (বড়মা) ছবি ছাপিয়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে বিজেপির। সমর্থকেরা ধ্বনি তুলছেন, ‘‘দিল্লিতে মোদী, বনগাঁয় কেডি।’’
কিন্তু ২০১৪ সালের সেই মোদী হাওয়ার দাপটেও যখন তাঁদের তৃতীয় স্থান পেয়ে থামতে হয়েছিল, এই বাজারে কতটা কী করতে পারবেন?
কেডি বলেন, ‘‘মানুষ এ বার খুবই চাপা। তবে প্রচারে বেরিয়ে দেখেছি, মানুষ ঘরের জানলা খুলে আমার দিকে হাত নাড়াচ্ছেন।’’ সেই হাতই ইভিএমে তাঁর দলের প্রতীকের পাশে চাপ দেবে, মনে করেন কেডি। বনগাঁ শহরকে ‘স্মার্ট সিটি’ করতে চেয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে জানালেন।
ফরওয়ার্ড ব্লকের তরুণ প্রার্থী সুশান্ত বাওয়ালি স্কুলে সংস্কৃত পড়ান। ভোটের ময়দানে এ বারই প্রথম। সাম্প্রতিক কালে বনগাঁয় বামেদের যে ক’টি মিছিল বেরিয়েছে, আকার-আয়তনে তা বামেদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর মতো বই কি! কথা হচ্ছিল বাম প্রার্থীর সঙ্গে। প্রথম বার ভোটের ময়দানে, এখনও কথাবার্তায় ততটা সড়গড় নন। অনুন্নয়ন নিয়ে দিস্তে দিস্তে অভিযোগের কথা তুলেছিলেন। পাশ থেকে এক প্রবীণ কর্মী কানের কাছ মুখ এগিয়ে বললেন, ‘‘গণতন্ত্র ফেরানোর কথাটা...।’’ ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বনগাঁয় গণতন্ত্র ফেরানোই হবে আমার প্রথম কাজ’’— কথা টেনে শেষ করলেন সুশান্ত।
বনগাঁয় বামেদের জোট সঙ্গী কংগ্রেসের অবশ্য তেমন মজবুত সংগঠন নয়। ২০১৫ সালে লোকসভার উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন মাত্র হাজার তিনেক ভোট। তবে সে বার প্রেক্ষিতটা আলাদা ছিল, দাবি করছেন বাম-কংগ্রেস নেতৃত্ব।
সুশান্তবাবুর প্রচারে ‘ছায়াসঙ্গী’ জেলা ফরওয়ার্ড ব্লকের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মৃত্যঞ্জয় চক্রবর্তী। বললেন, ‘‘প্রচারে বেরিয়ে দেখছি সাধারণ মানুষ তৃণমূল নেতৃত্বের উপরে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন গোপনে। মনে হচ্ছে এখানে মিরাকেল কিছু ঘটতে চলেছে।’’
সেই ‘মিরাকল’-এর ভরসাতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে বিরোধী শিবির।