বিজেপি প্রার্থী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের তোপের মুখে হাওড়ার ডেপুটি মেয়র মিনতি অধিকারী। সোমবার বামনগাছিতে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
প্রতিপক্ষ দাপিয়ে বেড়ালেও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন ক্রিকেটার। কিন্তু তাঁর টিমের লোকেরা হামলে পড়ে স্লেজিং শুরু করলেন।
সোমবার বিকেল তিনটে। হাওড়ার রত্নাকর নর্থপয়েন্ট স্কুলের সামনে হঠাৎ মুখোমুখি শাসক দলের প্রার্থী লক্ষ্মীরতন শুক্ল ও বিজেপির চ্যালেঞ্জার রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। দু’জনে সংক্ষিপ্ত করমর্দন সারলেন। একটু এগোতেই রূপার উদ্দেশে চোখা-চোখা বাক্যবাণ ভেসে এল। ‘ধুর শালা, নৌটঙ্কিবাজ’ কিংবা ‘নরেন্দ্র মোদীর হা...র টাকায় দশটা গাড়ি নিয়ে ঘুরছে!’ লক্ষ্মী তাঁর সঙ্গীদের থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।
শাসক দলের প্রার্থীর সামনেই যদি এই হয়, অন্য সময়ে কী হতে পারে, সহজে অনুমেয়। তারকা-প্রার্থী সালকিয়ার শিবগোপাল ব্যানার্জি লেন ধরে হাঁটার সময়েও তাঁকে লক্ষ্য করে টিটকিরি-গালিগালাজ ভেসে এল। উত্তর হাওড়া কেন্দ্রে বামনগাছি থেকে সালকিয়া— রূপা যেখানেই গিয়েছেন, ভোটাররা বিস্তর অভিযোগ নিয়ে ছুটে এসেছেন। নড়ে বসেছে সংবাদমাধ্যম। ততই পাল্টা চাপ দিতে শাসক দলের অভব্যতা মাত্রা ছাড়িয়েছে।
কিন্তু সন্ধে ছ’টায় শেষ বাঁশি বাজা অবধি মাঠ ছাড়েননি রূপা। মাঝে একবার নিজের অফিস-কাম-ডেরায় চাট্টি ডাল-ভাত-আলুভাজা ও পান্তুয়া খেয়ে এসেছেন। ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোটে শাসক দলের বুথজ্যাম বা ফাঁকা বুথে ‘ভূতেদের উপদ্রব’ নিয়ে তিনি সরব হয়েছেন। বলেছেন, ‘‘এরা যেমন নিখুঁত ভাবে ছাপ্পা দিল, তাতে আফশোস হয় ভাল কাজে মন দিলে রাজ্যটার উপকার হতো।’’ আবার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের অ্যাগনেস স্কুলে ভোট দেখে খুশি হয়ে ‘‘ভোট এমনই হওয়া উচিত’’ বলে উঠেছেন রূপা।
রূপা সারা ক্ষণ বুথে-বুথে লেগে আছেন দেখেই শাসক দলের তরফে তাঁকে ফাঁদে ফেলতে প্ররোচনার চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। যেমন হয়েছে, সালকিয়ার শ্রীকৃষ্ণ সেবাশ্রম শিক্ষা নিকেতনে। রূপা দু’নম্বর ঘরের বুথটিতে ঢুকতেই জনৈক নির্দল প্রার্থীর এজেন্ট চাপা স্বরে বললেন, ‘‘ওরা যা খুশি করে চলেছে!’’ তৃণমূলের এজেন্ট হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, ‘‘মিথ্যে কথা, এখনও কিছু করিনি!’’ প্রিসাইডিং অফিসার তখন মিনমিন করছেন। বুথের বাইরে রূপার সামনেই স্থানীয় বিজেপি-কর্মী অনিমেষ রায়কে হুমকি দিতে শুরু করে জনৈক লাল-নীল ডোরাকাটা টি-শার্ট— ‘‘রূপা গাঙ্গুলির পাশে বসে বিরাট নেতা হয়েছিস? দাঁড়া আজ বিকেলেই তোর ব্যবস্থা হবে।’’ রূপা রুখে দাঁড়াতে তৃণমূলীদের পাল্টা গলাবাজি: ‘‘আপনি কি মমতা ব্যানার্জি?’’, ‘‘সিনেমার লোক, সিনেমা করুন গিয়ে’’, ইত্যাদি। পরে মালিপাঁচঘরা থানায় রূপা ভোটারদের বাধা দিয়েছেন বলে তাঁর নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। যা শুনে রূপার প্রতিক্রিয়া, ‘‘সবাই দেখেছে কী হয়েছে!’’
সকাল সাড়ে সাতটায় বামনগাছির অরবিন্দ স্কুলে রূপা ঢুকতেই তাঁর কাছে তপন দাস, শানু মজুমদাররা অভিযোগ করেন— ‘‘আমাদের জোর করে টিএমসিকে ভোট দিতে বাধ্য করানো হয়েছে।’’ রূপা শুনে বিহিত চাইতে ভিতরে গেলেন। জোট-সমর্থিত কংগ্রেস-প্রার্থী সন্তোষ পাঠকও তখন সেখানে। খবর পেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেকশন অফিসার বুথে এলেও অভিযোগ কিন্তু ‘প্রমাণ’ করা গেল না। তবে বুথে নিরক্ষর এক ভোটকর্মী অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন বলে রূপা অভিযোগ করেছেন। একটু বাদে রূপাকে দেখে জনৈক কংগ্রেস কর্মী অভিযোগ জানান, ‘‘দিদি ওরা কিন্তু আমাদের ভোট দিতে যেতে আটকাচ্ছে! রেল কোয়ার্টারের দিকটা দেখুন।’’ সে-দিকে গিয়ে রূপা জটলাটা সরানোর চেষ্টা করলেন। ‘‘তোমরা ভোট না-দিয়ে ভিড় করছ কেন? ভোট দেওয়ার হলে, যাও দিয়ে এসো!’’— বলে সানগ্লাসধারী এক যুবককে হাত ধরে বুথের দিকে কিছুটা এগিয়েও দিলেন।
রূপার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি এ দিন বারবার শাসক দলের গাত্রদাহের কারণ ঘটিয়েছে। সেন্ট্রাল স্কুলে জনৈক ‘ডামি’ প্রার্থীর এজেন্ট হয়ে ঢুকে চেঁচামেচি শুরু করেন হাওড়ার ডেপুটি মেয়র মিনতি অধিকারী। রূপা মেজাজ হারিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন। তৃণমূলের তরফে রূপার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি সমস্যার সৃষ্টি করছে বলে এ দিন কমিশনের কাছে অভিযোগও করা হয়। বিজেপির কেন্দ্রীয় মহিলা নেত্রী পূজা কপিল মিশ্রের কাছে রূপা ফোনে দুঃখ করেছেন, ‘‘অবজার্ভাররাও ফোন তুলছেন না।’’
তাঁর মাথায় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যতই হাত থাকুক, ভোটের ময়দানে শাসক দলের মেশিনারির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কাজটা এ দিন কার্যত একাই করতে হয়েছে টিভি সিরিয়ালের দ্রৌপদীকে। বিজেপির মহিলা মোর্চার গুটিকয়েক নেত্রী ও হাতে-গোনা স্থানীয় কর্মী শুধু পাশে। তবু দিনশেষে রূপার আশা, ‘‘মানুষ আমার পাশেই থেকেছেন।’’
অর্থাৎ, এ কুরুক্ষেত্রে নিজেকে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ বলে মানতে রাজি নন দ্রৌপদী।