সোহরাব আলি
দিদির দুনিয়ায় সবই হয়! সব সত্যি!
দিদি বলেছেন, আগে জানা থাকলে নাকি ভেবে দেখতেন! কিন্তু জানা থাকলেই ভাবা হয়, এমন কথা বলার উপায় এ রাজ্যের প্রশাসন এবং বিধানসভা রাখেনি!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি, নারদ-কাণ্ডের ফুটেজ যখন প্রকাশ্যে এসেছে, তত দিনে বিধানসভায় তাঁর প্রার্থী ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে। তাই আর বদলানোর নাকি উপায় ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীর এমন দাবিতে বড়সড় ছিদ্র ধরিয়ে দেওয়ার জন্য হাতের কাছে আছেন তৃণমূলেরই এক বিধায়ক! রানিগঞ্জের সোহরাব আলি। রেলের যন্ত্রাংশ চুরির দায়ে আসানসোলের আদালত যাঁকে দু’বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। সোহরাবের বিধায়ক-পদ খারিজের দাবি তুলে বিধানসভা থেকে রাজভবন, সর্বত্র দরবার করেছে বিরোধীরা। কিন্তু সোহরাব দিব্যি বিধায়ক রয়ে গিয়েছেন!
অথচ আইন কী বলছে? সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, সাংসদ বা বিধায়কের মতো কোনও জনপ্রতিনিধির দু’বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডের আদেশ হলেই সংসদ বা বিধানসভা থেকে তাঁর সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। যে ভাবে দুর্নীতির মামলায় সাংসদ পদ খুইয়েছেন আরজেডি-র লালুপ্রসাদ যাদব। কিন্তু বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েও সোহরাব পার পেয়ে গেলেন! বিরোধীদের লাগাতার দাবির মুখে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমাগত জানিয়ে গেলেন, আদালত থেকে নির্দেশের কাগজ বিধানসভায় এসে পৌঁছয়নি! তাই কিছু করার নেই। এমন ঘটনায় সংবিধানের গুরুতর অমর্যাদা হচ্ছে বলে অভিযোগ জানাতে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। কলকাতায় ভোটের প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদী দুর্নীতির প্রশ্নে দিদিকে যতই হুল ফোটান না কেন, কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপালের হস্তক্ষেপে কিন্তু সোহরাব মামলার সুরাহা হয়নি।
আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সোহরাব অদ্ভুত ভাবে বেঁচে তো গিয়েছেনই। আবার নারদ-কাণ্ডে অভিযুক্ত মন্ত্রী তথা বিধায়ক সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের বিরুদ্ধে বিধানসভায় কোনও তদন্ত প্রক্রিয়াই হয়নি! একই ঘটনায় অভিযুক্ত সাংসদদের ক্ষেত্রে লোকসভার এথিক্স কমিটি তদন্ত করছে, অভিযুক্তদের নোটিসও দিয়েছে। কিন্তু দিদির রাজ্যে কোনও কমিটি নেই! কোনও তদন্তও নেই!
তথ্য বলছে, কয়েক বছর আগে স্টিং অপারেশনেই টাকা নেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন নন্দীগ্রামের সিপিআই বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াস। বিধানসভার তৎকালীন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম সে বার কংগ্রেসের জ্ঞান সিংহ (চাচা) সোহনপালের নেতৃত্বে অ্যাড হক কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন অভিযোগের তদন্তের জন্য। তৃণমূল বিধায়ক সৌগত রায় ২০০৭ সালের সেই ঘটনায় ইলিয়াসের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাবও এনেছিলেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা পড়ার আগেই অবশ্য কলঙ্কের ভার নিতে না পেরে ইলিয়াস বিধায়ক এবং দলের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। পরিবর্তনের জমানায় না আছে তদন্ত, না ইস্তফা!
বর্তমান স্পিকার বিমানবাবুর ব্যাখ্যা, সোহরাব ও নারদ— দুই ক্ষেত্রেই বিধানসভার কিছু করার ছিল না। ভোটের প্রচারের ব্যস্ততার ফাঁকে ঘটনাচক্রে সোমবারই আধঘণ্টার জন্য বিধানসভায় নিজের দফতরে এসেছিলেন স্পিকার। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সোহরাবের ব্যাপারে আদালতের কাগজপত্র এখনও আমাদের কাছে আসেনি।’’ আর নারদ-কাণ্ডে তদন্ত এবং কমিটি? স্পিকার বলছেন, ‘‘নারদ-কাণ্ড প্রকাশ্যে এসেছে ১৪ মার্চ। তখন ভোট ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। এই সময়ে বিধানসভায় নতুন কোনও কমিটি গড়া হয় না। পুরনো কমিটিগুলির অস্তিত্ব আছে ঠিকই। কিন্তু সেখানে নতুন কোনও বিষয় আর বিবেচনার জন্য পাঠানো হয় না।’’
দুই ঘটনায় এই দুই ব্যাখ্যা নিয়েই পাল্টা প্রশ্ন আছে। আসানসোলের আদালত থেকে সোহরাব-মামলার রায়ের সার্টিফায়ে়ড কপি জোগাড় করে বিধানসভায় জমা দিয়েছিলেন পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। রায়ের কাগজ না পাঠিয়ে আসানসোলের বিচারক স্পিকারের অমর্যাদা করছেন, এই মর্মে বিধানসভার অধিবেশনে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব এনেছিলেন সূর্যবাবুরা। কোনওটাই গৃহীত হয়নি।আর নারদ-কাণ্ডে প্রাক্তন পরিষদীয় মন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান বিধায়ক প্রবোধ সিংহের প্রশ্ন, ‘‘ভোট চললেও বিধানসভা কিন্তু ভেঙে দেওয়া হয়নি। এই সময়ে নতুন কোনও কমিটি বা তদন্ত হবে না, এটা রেওয়াজ। আইনে তো ঠিক এই ভাবে কিছু লেখা নেই। সদিচ্ছা থাকলে কি এর মধ্যেও তদন্ত করা যেত না?’’
বিরোধীরা বলছে, বিধানসভার তদন্তের আওতায় এলে সুব্রত, ফিরহাদ, শোভনদের প্রার্থী হওয়া নিয়ে জটিলতা হতে পারত। তাই হয়তো ‘সদিচ্ছা’র কথা কেউ মাথায় আনেনি! আর ‘সদিচ্ছা’র দৃষ্টান্ত হিসাবেই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য উল্লেখ করছেন কেউ কেউ। রানিগঞ্জে প্রচারে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, বাম আমলের একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছেন ‘বেচারা’ সোহরাব! আদালতের রায় আছে বলে তাঁর স্ত্রীকে প্রার্থী করেছেন। নইলে সোহরাবকেই করতেন!
সূর্যবাবুরা বলছেন, এখন আর মাথা ছেড়ে শুধু কান টানলে হবে না! বিরোধী দলনেতার কথায়, ‘‘সব দলেই কিছু অসাধু লোক থাকে। কিন্তু এখানে সব ধরনের চোরে মিলে একটা দল করেছে। লোহাচোর, মাটিচোর, ঘুষখোর সবাইকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী! আর এখন নিজে বাঁচার জন্য বলছেন, আগে জানলে ভেবে দেখতাম!’’