প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
বাংলায় এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগকেই যে তাঁরা মূল হাতিয়ার করতে চান, ভোট ঘোষণার আগে দ্বিতীয় বার রাজ্যে এসে ফের সেই কৌশলই স্পষ্ট করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর দাবি, শুধু ক্ষমতার বদল নয়। বাংলায় তাঁরা ‘আসল পরিবর্তন’ চান। মোদীর মতে, সেই ‘আসল পরিবর্তন’ মানে হল ‘দুর্নীতি, সিন্ডিকেট-রাজ, তোলাবাজি, কাটমানি সংস্কৃতিমুক্ত’ বাংলা।
হুগলি জেলার সাহাগঞ্জে ডানলপ মাঠে সোমবার বিজেপির সভায় দাঁড়িয়ে মোদী বলেছেন, ‘‘বাংলার মানুষ পরিবর্তনের জন্য মনস্থ করে ফেলেছেন। এখানে সঠিক অর্থে পরিবর্তন আনতে হবে। যত দিন সিন্ডিকেট থাকবে, তত দিন বাংলার উন্নতি সম্ভব নয়। তোলাবাজেরা থাকাকালীন বাংলার উন্নতি সম্ভব নয়। প্রশাসন যত দিন গুন্ডাদের আশ্রয় দিয়ে যাবে, তত দিন এখানে উন্নতি সম্ভব নয়!’’ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান— ‘‘আর নয় অন্যায়! আমরা আসল পরিবর্তন চাই।’’
সাহাগঞ্জের মাঠে এ দিন ভিড় হয়েছিল চোখে পড়ার মতোই। একই মাঠে কাল, বুধবার সভা করতে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি মোদীর কথার জবাব দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
একই মাঠে অন্য মঞ্চ থেকে এ দিন একগুচ্ছ রেল-প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সূচনা করেছেন নোয়াপাড়া থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত মেট্রো রেল সম্প্রসারণের। ডানকুনি থেকে বারুইপাড়া পর্যন্ত চতুর্থ লাইন, রসুলপুর থেকে মগরা এবং কলাইকুন্ডা থেকে ঝাড়গ্রামের মধ্যে তৃতীয় লাইন উদ্বোধন করেছেন তিনি। সূচনা হয়েছে আজ়িমগঞ্জ থেকে খাগড়াঘাট রোড পর্যন্ত ডবল লাইনের। এর মধ্যে মেট্রো সম্প্রসারণের প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন মমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী থাকাকালীন। খাগড়াঘাট রোডের প্রকল্প মঞ্জুর হয়েছিল কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী রেল প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন। উদ্বোধন করতে গিয়ে আত্মনির্ভর ও আধুনিক ভারত এবং বাংলা গড়তে পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেছেন মোদী।
মোদীর রেল-উদ্বোধনের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় টুইটে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘রেলমন্ত্রী মমতা ২০১০ সালে দমদম থেকে দক্ষিণেশ্বর মেট্রোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। কেন্দ্রে বিজেপির সরকার সাত বছর ধরে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করেনি আর এখন ভোটের আগে মোদীজি কৃতিত্ব নিতে দৌড়চ্ছেন’! পাশাপাশিই প্রধানমন্ত্রীর পাল্টা তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায়ের দাবি, ‘‘মোদী যে পরিবর্তনের কথা বলছেন, তা হলে বাংলার সর্বনাশ হবে! বাংলার মানুষ ঠিক করে ফেলেছেন, তৃতীয় বারের জন্য মমতাই সরকার গড়বেন।’’
দুই বিরোধী কংগ্রেস ও সিপিএমও মোদীকে কটাক্ষ করেছে। বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, ‘‘দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলার কথা বলছেন কিন্তু বিভিন্ন কেলেঙ্কারির তদন্তের কী হল? ভোটের সময় এলেই কেন্দ্রীয় সংস্থা সক্রিয় হয় আর বিজেপি নেতারা এসে নানা রকম দাবি করেন।’’ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘কেন্দ্রের দুর্নীতিবাজ এসে রাজ্যের দুর্নীতি দূর করতে পারে না! রাজস্থান, গুজরাতে মাফিয়া-রাজ হয়নি, মধ্যপ্রদেশে ব্যপম-কাণ্ড হয়নি? সরকারি টাকা ভোটের প্রচারে ব্যবহার করে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা বাংলার সংস্কৃতি শেখাচ্ছেন!’’
অন্য বারের মতো এ বার ‘পিসি-ভাইপো’র নাম নিয়ে আক্রমণে যাননি মোদী। তবে রাজ্য জুড়ে সিন্ডিকেট, কাটমানির কারবারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘‘বাংলায় বিনিয়োগ করতে মুখিয়ে রয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এখানকার সরকার যে পরিবেশ তৈরি করেছে, যে ভাবে সিন্ডিকেটের হাতে বাংলাকে তুলে দিয়েছে, তাতে অনেকেই বিমুখ হয়ে পড়ছেন। বিদেশে যখন প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে দেখা হয়, সকলেই মাতৃভূমির উন্নতিতে যোগদানে প্রস্তুত। কিন্তু করবেন কী করে। সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া ভাড়ায় ঘরও পাওয়া যায় না এখানে!’’
বিশুদ্ধ পানীয় জল প্রকল্পের প্রসঙ্গ এনে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, প্রতি ঘরে জল পৌঁছে দিতে ১৭০০ কোটির বেশি টাকা দিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু সামান্য টাকা খরচ করে ১১০০ কোটি টাকা ‘নিজেদের পকেটে ভরেছে’ রাজ্য। মোদীর প্রশ্ন, ‘‘বাংলার মেয়েদের জল পাওয়া উচিত নয় কি? এদের ক্ষমা করবেন আপনারা? পদ্ম ফোটানো এই জন্যও জরুরি, যাতে বাংলায় সঠিক অর্থে পরিবর্তন আসতে পারে।’’
‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি’ বা ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের কথাও এ দিন ফের শোনা গিয়েছে মোদীর মুখে। তাঁর দাবি, ‘‘বাংলার উন্নতির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মা-মাটি-মানুষের সরকার। কৃষক ও গরিবের পয়সা তাদের অ্যাকাউন্টে ঢুকছে। তৃণমূলের নেতাদের প্রতিপত্তি বেড়েছে আর সাধারণ মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বাংলার লক্ষ লক্ষ দরিদ্র পরিবার আয়ুষ্মান ভারতের আওতায় ৫ লক্ষ টাকার সুবিধা থেকে আজও বঞ্চিত।’’
এই সব সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য মোদীর ‘দাওয়াই’ একটাই— পদ্ম ফুটিয়ে ‘আসল পরিবর্তন’ এনে ‘সোনার বাংলা’ গড়া!