ময়ূরেশ্বরে বোমাবাজিতে আহত তৃণমূল কর্মী।
ভোটের দিন বিরোধীদের ভ্যানিশ করে দেওয়ার তত্ত্ব আউড়ানোয় তাঁকে নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বৃহস্পতিবার বীরভূমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হয়ে ব্যাট করে দেওয়ার পরেই অনুব্রত মণ্ডলের কথাবার্তায় যেন ‘কে কমিশন, কে কমিশন’ ভাব। আর ‘কেষ্টদা’র (অনুব্রতর ডাকনাম) ‘ভ্যানিশ’ কৌশল কার্যকর করতে তাঁর ‘ভূতেরা’ আগেই মাঠে নেমে পড়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। কারণ, গত ২৪ ঘণ্টায় ইলামবাজার, লাভপুর এবং ময়ূরেশ্বরে বিরোধীদের উপরে হামলায় অভিযুক্ত শাসক দলের নেতা-কর্মীরাই।
আনন্দবাজারকে ১৭ এপ্রিল, বীরভূমে ভোটের দিন ‘ভ্যানিশিং স্ট্র্যাটেজি’ ব্যবহার করার কথা আগাম জানিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত। কৌশল খোলসা করতে গিয়ে জানান, সে দিন বিরোধীদের ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া হবে, ভোট করানো হবে ‘গুড়-জল’ দিয়ে। তাঁর এমন মন্তব্যে সাড়া পড়ে কমিশনেও। দিল্লি থেকে কমিশনের কর্তারা রাজ্যের নির্বাচনী আধিকারিকদের কাছে জানতে চান, একতরফা ভোট করার হুমকি দিলেও কেন অনুব্রত মণ্ডলের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বুধবার থেকে অনুব্রত সুর একটু নরম করেছিলেন। সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করেছিলেন, ‘‘বীরভূমে মারামারি হবে না।’’
ময়ূরেশ্বরের রেজা গ্রামে আহত সিপিএম কর্মী
বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। বুধবার সন্ধ্যার মুখে ইলামবাজারের ধরমপুরে মিছিল করছিল সিপিএম-কংগ্রেস জোট। আচমকা কিছু তৃণমূল কর্মী মিছিলে চড়াও হয়ে মারধর করে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ। সে দিনই আক্রান্ত হন লাভপুরের সিপিএম প্রার্থী মাহফুজুল করিম। তাঁর কথায়, ‘‘আমোদপুরে দলের অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই তৃণমূলের জনা পাঁচেক এসে আগ্নেয়াস্ত্র দেখায়। পরে আমাকে হুমকি দিয়ে ওরা চলে যায়।’’
ওই রাতেই গোলমাল বাধে ময়ূরেশ্বরের বেজ গ্রামে। সিপিএম ও বিজেপি কর্মীদের অভিযোগ, দলের সভা-মিছিলে না যাওয়ার ‘ফতোয়া’ দিয়ে গিয়েছিল তৃণমূলের লোকজন। তা না মানায় তাঁদের বাড়ি-বাড়িতে হামলা হয়। লাঠি-রড দিয়ে মারধরে সিপিএম এবং বিজেপি-র তিন জন করে কর্মী জখম হয়েছেন বলে অভিযোগ। আহত সিপিএম কর্মী কেয়ামত শেখ, জামিরুল শেখদের অভিযোগ, ‘‘কয়েকদিন ধরে তৃণমূলের লোকেরা মিটিং-মিছিলে গেলে মারধর করার হুমকি দিচ্ছিল। তা আমরা মানিনি। সে জন্য আমাদের পেটাল!’’
তৃণমূলের যদিও পাল্টা দাবি, ওই গ্রামে বিজেপি-সিপিএম মিলে তাদের কর্মীদের উপরেই বোমাবাজি করেছে। সেই অভিযোগ উড়িয়ে বিজেপি নেত্রী লকেটের অভিযোগ, ‘‘এ সব হচ্ছে অনুব্রত মণ্ডলের ‘ভ্যানিশ’ তত্ত্বের পূর্বাভাস।’’ প্রায় একই সুরে ময়ূরেশ্বরের সিপিএম প্রার্থী অভিজিৎ রায়ের মন্তব্য, ‘‘দাদার (অনুব্রত) কথার মান রাখতে প্রাণপাত শুরু করেছে তাঁর ভূতেরা।’’ পুলিশ জানায়, তিন দলই হামলার অভিযোগ করেছে। ৩৫ জনের খোঁজ চলছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চুপচাপই ছিলেন অনুব্রত। এ দিন মুরারই ও সিউড়িতে তাঁর দলনেত্রীর সভা ছিল। সকালে বাড়িতে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক, নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় সেরে দুপুরে সিউড়ির সভাস্থলে পৌঁছে যান অনুব্রত। তখনও মমতার পৌঁছতে অনেকটা দেরি। সভার কাজকর্ম নিয়ে নানা নির্দেশ দিচ্ছিলেন অনুব্রত। মাঝে কখনও পায়চারি করেছেন, কখনও মঞ্চে মমতার বড় ছবির সামনে চেয়ারে বসে পড়েছেন। কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ।
বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ মমতা পৌঁছতেই হেলিপ্যাডের দিকে দৌড়ে যান কেষ্ট। নেত্রীর পাশে-পাশে হেঁটে এসে মঞ্চে ওঠেন। গোড়ায় মিনিট চারেক বক্তব্য রাখেন সাংসদ শতাব্দী রায়। সেই সময় মঞ্চে অনুব্রত দলনেত্রীর সঙ্গে একান্তে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। এর পরে মমতার প্রায় ৪৫ মিনিট ভাষণের সময়ে মঞ্চের এক দিকে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন অনুব্রত। মমতা যখন বলেন, ‘‘কেন অনুব্রত করেছেটা কী? ... (মহম্মদ) সেলিম, সুজনরা (চক্রবর্তী) অ্যারেস্ট হবে না? নন্দীগ্রাম কেসে বুদ্ধবাবুরা অ্যারেস্ট হবে না? আর অনুব্রত অ্যারেস্ট হবে?’’ হাসি ফোটে কেষ্টর মুখে। এর পর থেকে অনেকটা সময় খোশমেজাজেই দেখা গিয়েছে তাঁকে। দলনেত্রী চলে যেতে অনুব্রতও হাসিমুখে নলহাটির সভায় যোগ দিতে রওনা হয়ে যান।
এমন আবহে ভোটের দিন অনুব্রতর ‘দাওয়াই’ কমিশন কতটা ঠেকাতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় বিরোধী-শিবিরে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সিউড়ির প্রার্থী রামচন্দ্র ডোমের কথায়, ‘‘কমিশনের ফুল বেঞ্চ আসা, মুখ্যমন্ত্রীকে শো-কজ করা বা অনুব্রতর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা— এতে খানিকটা চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে কার্যক্ষেত্রে কী হয়, সেটা দেখতে হবে। কারণ, অনুব্রতর ভূতেরা ময়দানে নেমে পড়েছে।’’