বাঘমুণ্ডির সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার। ছবি: সুজিত মাহাতো
ঠিক হুঁশিয়ারি নয়। বরং বক্তব্য শুনলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন মধু ঢালা! কিন্তু, ওই মধুর প্রলেপের তলায় রয়েছে আসলে হুঁশিয়ারি, এমনই মনে করছে এ রাজ্যের বিরোধী দলগুলি।
রবিবার পুরুলিয়ার তিন জনসভায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে যা বলেছেন, তা গত ক’দিনের চড়া সুরের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। জঙ্গলমহলের বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর ও বরাবাজারের সভায় তিনি বলেছেন, ‘‘ইলেকশন আসলে অনেক কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে। ইলেকশন কমিশনের অবজার্ভার আসবে। কোনও দিন তাঁদের ভুল বুঝবেন না। যত্ন করবেন, আদর করবেন। তাঁরা আমাদের অতিথি। অতিথিকে যত্ন করা আমাদের কাজ। তাঁরা কিছু বললে চুপচাপ শুনবেন।’’
রাজ্যের মসনদে বসা ইস্তক নির্বাচন কমিশনকে নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা মমতার মুখে এ হেন কথা শুনে অনেকেরই মনে হয়েছে, হলটা কী! ক’দিন আগেও যিনি হুঙ্কার ছাড়ছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী বা কমিশন তিন দিনের জন্য, তার পরে আমরাই থাকব’, তাঁর গলায় হঠাৎ কমিশন-বাহিনী সম্পর্কে এমন সুর কেন?
ভুল অবশ্য ভেঙে দিচ্ছে এ দিনই মমতার পরের মন্তব্য— ‘‘ইলেকশন হয়ে গেলে আমাদের সরকারই থাকবে। আপনারা যেমন ছিলেন তেমনিই থাকবেন।’’ যা শুনে বিরোধীরা বলছেন, ‘‘এ হল চিনির আড়ালে চিরতা! ক’দিন সরাসরি কমিশনকে বিঁধে সমালোচনার মুখে পড়ে এ বার ঘুরপথে ভোটারদেরই হুঁশিয়ারি দিলেন মমতা। বলে রাখলেন, কমিশন চলে গেলে তৃণমূলেই থাকবে এলাকায়। ভোটারদেরও তৃণমূলকে সঙ্গে নিয়েই থাকতে হবে।’’ একই সঙ্গে তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত লোকসভা ভোটের আগে কমিশন মুখে বিস্তর হাঁকাহাঁকি করলেও পর্যবেক্ষকদের নানা উপায়ে ‘হাতে রেখে’ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কার্যত বসিয়ে রেখে ভোট করিয়েছিল শাসকদল। সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘মমতা যে ভাবে এ দিন পর্যবেক্ষকদের ‘যত্ন’ করার কথা বলেছেন, তা কিন্তু দু’বছর আগের স্মৃতিই ফিরে আসছে।’’ এক কংগ্রেস নেতা বলছেন, ‘‘সে বার এক পর্যবেক্ষককে তো তৃণমূল পটনায় নিয়ে গিয়ে খাতিরযত্ন করেছিল বলেও শুনেছি। আমরা সে কথা এ বার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীকে দিল্লিতে গিয়ে পইপই করে বলে এসেছি।’’
ঘটনা হল, ভোটের অনেক আগে থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে এসেছে রাজ্যে। তাদের কোথায়, কী ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, তার রিপোর্ট প্রতিদিন তলব করছে কমিশন। একের পর এক কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকও পাঠাচ্ছে দিল্লির নির্বাচন সদন। কমিশনের এই উদ্যোগ যে তাঁদের অস্বস্তিতে রেখেছে, ভোটের প্রচারে নিজেদের বক্তৃতায় তা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন মমতা-সহ তাবড় তৃণমূল নেতৃত্ব। পিসি যখন কমিশনকে কটাক্ষ করছেন ‘তিন দিনের অতিথি’ কিংবা ‘ভোট হয়ে গেলে আমাদেরই দেখতে হবে’ বলে, তখন সাংসদ-ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সুর আরও চড়িয়ে বিরোধীদের উদ্দেশে ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দেখে নেওয়ার’ হুমকি দিচ্ছেন। শনিবার দুপুরে পুরুলিয়ারই সাঁওতালডিহির বীরসাচক ময়দানের নির্বাচনী সভায় অভিষেক সিপিএম-কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন, ‘‘তোমাদের সৌজন্য (দেখানো) অনেক হয়েছে, সুযোগ অনেক দিয়েছি, ভদ্রতা অনেক হয়েছে। আগামী দিনে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তোমাদের জবাব দেওয়া হবে। তোমরা তৈরি থাকো।’’
অভিষেকের মন্তব্য ‘উস্কানিমূলক’ জানিয়ে বিধিভঙ্গের অভিযোগ কমিশনে জানিয়েছিল বামফ্রন্ট। এর পরেই কমিশন পুরুলিয়ার জেলাশাসকের কাছে অভিষেকের বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ পাঠানোর নির্দেশ দেয়। রবিবার রাতেই কমিশনে ওই ফুটেজ পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার ভিডিও ফুটেজও ইতিমধ্যেই দিল্লিতে কমিশনের দফতরে পাঠিয়েছে রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতর। তবে প্রশ্ন উঠেছে, অনুব্রত মণ্ডল, আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা কিংবা বিরোধী দলের মহম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে যে ভাবে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে তড়িঘড়ি নোটিস পাঠানো হয়, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। অভিষেকের বিরুদ্ধেও কি আদৌ শেষমেশ কমিশন কোনও ব্যবস্থা নেবে? কমিশনের এক কর্তার কথায়, ‘‘দু’টিই দিল্লিতে কমিশনের বিচারাধীন। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই। কমিশন যেমন সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তা পালন করব।’’